কাঠগড়ায় মওদুদ-খন্দকার

দুটি বই নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে জাতীয় রাজনীতিতে। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি প্রধান দুই দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তোপের মুখে পড়েছেন এ দু’দলের সিনিয়র দুই নেতা। প্রায় দু’সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়েছে আলোচিত দুটি বই।

একটির সমালোচনা চলমান থাকতেই আরেকটির বিতর্ক শুরু। জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল উত্থাপন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলাকালে এই বই দুটি পাঠকের হাতে পৌঁছে। একটি লিখেছেন কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি এ কে খন্দকার। অপরটির লেখক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। কাকতালীয়ভাবে এই দুই নেতার মধ্যে অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। দু’জনেই দেশের দুই প্রধান দলের সিনিয়র নেতা, দুজনের দু’দলের সাবেক মন্ত্রী, দুজনই মুক্তিযোদ্ধা। একজন লিখেছেন ৪০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে। আরেক জন লিখেছেন নিকট অতীত ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপট নিয়ে। স্মৃতিচারণমূলক বই দু’টি নিয়ে লেখকদ্বয় নিজ দল আদর্শ এবং মতের লোকের কাছেই হয়েছেন সমালোচিত। দলীয় লোকের দেয়া মামলায় ইতিমধ্যে আসামি হয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সেকেণ্ড-ইন কমান্ড এ কে খন্দকার। জাতীয় সংসদে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। অপরদিকে তীর্যক কটাক্ষ এবং নিন্দার মুখে পড়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বই প্রকাশ যে কোন নাগরিকের মৌলিক এবং মত প্রকাশের অধিকার। এটা যাদের পছন্দ হবে না তারা সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু কারও কণ্ঠরোধ করতে পারে না। তিনি বলেন, প্রকাশিত বইয়ের অনেক বিষয়ে আমারও দ্বিমত আছে। তবে কারও মত প্রকাশের অধিকারে বাধা দান কিংবা কণ্ঠরোধে আমি বিশ্বাসী নই। উল্লেখ্য, ২রা সেপ্টেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডির একটি মিলনায়তনে প্রকাশনা উৎসবের মাধ্যমে পাঠকের হাতে আসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক বই ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’। স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা বিষয় স্থান পায় এ কে খন্দকারের বইয়ে। যার কিছু অংশ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমেও। এর পর ৪ঠা সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা এ বইয়ের তীব্র সমালোচনা করে বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানান। একই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের এ উপ-অধিনায়কের শাস্তিও দাবি করেন। সংসদে তুমুল আলোচনার পর দিন আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বই নিয়ে দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। একই সঙ্গে বিএনপির নেতারাও এ নিয়ে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা এ কে খন্দকারের বইয়ের তীব্র সমালোচনা করলেও দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বইটি নিষিদ্ধ না করে এ কে খন্দকারের বক্তব্যের তথ্যভিত্তিক জবাব দেয়ার পক্ষে মত দেন। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ কে খন্দকার সত্য প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগের গা জ্বালা শুরু হয়েছে। ওদিকে এ কে খন্দকারের বইয়ের প্রতিক্রিয়া পর্ব শেষ না হতেই দৃশ্যপটে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। প্রায় একই রকম সমালোচনার মুখে পড়েছেন বর্ষীয়ান এ নেতাও। শনিবার সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখিত ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ’ শীর্ষক বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। প্রকাশিত বইয়ে জঙ্গিবাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক, ছেলেদের প্রতি খালেদা জিয়ার প্রীতি এবং চারদলীয় জোট সরকারের দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসায় তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
মওদুদের বই নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া বিএনপিতে
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটার ম্যাথ: ২০০৭-২০০৮’ বইটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। বইটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সিনিয়র এ সদস্য। তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তার প্রকাশ্য সমালোচনা করছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। অভিযোগ ওঠেছে, ‘সরকারের সন্তুষ্টি অর্জন এবং বাড়ি রক্ষার জন্য’ তিনি কিছু মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য সংযুক্ত করেছেন বইটিতে। গতকাল আলাদা দুইটি অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সমালোচনা করেন দলটির কেন্দ্রীয় দুই নেতা। তবে সে অভিযোগের জবাব দিয়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।  দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা বইয়ের কড়া সমালোচনা করেছেন দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। সকালে নয়াপল্টন কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, উনি বইতে লিখেছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও হাওয়া ভবনের দুর্নীতির কারণে নাকি জোট সরকারের বিদায় হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে আমি এ বিষয়ে কিছু বলবো না। তবে ব্যক্তিগতভাবে বলবো- ওই সময়তো তিনি একজন মন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাহলে ওই সময়ে তিনি কেন পদত্যাগ করলেন না? রিজভী বলেন, নিজের ছেলেদের ছাড়ানোর ব্যাপারে যদি খালেদা জিয়া ব্যস্ত থাকতেন তাহলে তিনি আগেই ছেলেদের মুক্ত করে বিদেশে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু খালেদা জিয়া ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সঙ্গে আপস করেননি। দেশের জনগণের কথা ভেবে তিনি দেশ ত্যাগ করেননি। তার ওপর অনেক চাপ ছিল বলেই তারেক রহমানের ওপর বন্দি অবস্থায় নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছেন। রিজভী বলেন, মওদুদ আহমদের মতো একজন জ্যেষ্ঠ নেতা কাদের খুশি করার জন্য এই বই লিখেছেন তা আমার জানা নেই। মনে হয়, নিজের বাড়ি রক্ষায় ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্টি করতেই মওদুদ আহমদ তার বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। তিনি অনেক দিন ধরে রাজনীতি করেন, তবে যখনই নিজের স্বার্থ আসে তখনই রং বদলান। যারা ডিগবাজ, দলছুট, আদর্শছুট এবং নিজের প্রয়োজনে দল বদলান জনগণ তাদের চেনে। ভারতীয় এক প্রখ্যাত সাংবাদিকের এসব নেতাকে ফাস্টফুডের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। মওদুদ আহমদের প্রতি ইঙ্গিত করে রিজভী আহমেদ বলেন, কাক সাত সমুদ্র তের নদী  পেরিয়ে গেলেও কাকই থাকে। কোন আদর্শহীন ও দলছুট নেতার বইয়ে বিএনপির কিছুই আসে যায় না। দেশের মানুষ তার কথায় বিভ্রান্ত হবে না। নিজেদের স্বার্থে সময়ের প্রয়োজনে যারা রঙ বদলায় মানুষের কাছে তারা ধরা পড়ে যান। ওদিকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, ‘গতকাল কে জানি বলেছেন, আমাদের ড. মাহবুব উল্লাহ স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি নোয়াখালীর লোক। এটা কি? এটা কই পাইলেন তিনি?’ জাতীয় প্রেস ক্লাবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান মুক্তি পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মওদুদ আহমদের লেখা ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটার ম্যাথ’ বইয়ের সমালোচনা করে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।
রিজভী অনুতপ্ত হবে: মওদুদ
সদ্য প্রকাশিত বই নিয়ে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, আমি খুব দুঃখ পেলাম। কারণ রিজভীকে আমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো মনে করি। তার অনেক লেখাপড়া আছে। সে যে মন্তব্য করেছে আমি এটা তার কাছ থেকে আশা করিনি। পুরো বই পড়লে সে অনুতপ্ত হবে। নিজের বাড়ি নিয়ে সমস্যা তৈরির অনেক আগেই এ বই লেখা হয়েছে বলেও দাবি করেন সাবেক এই আইনমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। ওয়ান ইলেভেনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ: ২০০৭-২০০৮’ নিয়ে এরইমধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সোমবারই এক সংবাদ সম্মেলনে এ বইয়ের জন্য মওদুদ আহমদের তীব্র সমালোচনা করেন। বাড়ি রক্ষা করতে সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য মওদুদ আহমদ এ বই লিখেছেন কিনা সে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের আরও বলেন, বই লেখা এক জিনিস। এটা একটা কঠিন কাজ। বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনীতির ওপর কোন বই লেখা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম আমার দল বা দলের নেতা-কর্মীরা এপ্রিসিয়েট করবে এবং আমিতো ভেবেছিলাম রিজভী আমাকে অভিনন্দন জানাবে, ধন্যবাদ জানাবে এই ধরনের একটি বই লেখার জন্য। কারণ আমি যেটা ভয় করেছিলাম, বইটা বের হওয়ার পরে সরকার আমার উপর অসন্তুষ্ট হবে। হয়তো আমাকে আবার জেলখানায় যেতে হতে পারে। বইটি যদি পড়া হয় তাহলে দেখা যাবে ২০০৭-২০০৮ সালে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার কিভাবে রাজনীতিবিদদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। বিশেষ করে শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য বিএনপিকে দুর্বল করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সহায়তায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তারই বিবরণ বইতে দেয়া আছে। এখন দেখছি, ফল উল্টো। আমার দল সম্পর্কে বা আমার দলের যে ব্যর্থতা বা আমরা  যে পরাজিত হলাম এর অনেকগুলো কারণ আমার বইতে দেয়া আছে। পত্রিকাগুলো তাদের পলিসি অনুযায়ী সংবাদ প্রকাশ করেছে। নির্বাচন যে হয়েছে ২০০৮ সালে সেখানে বলা আছে এটা কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। কিভাবে কারচুপি হয়েছে তা বলা আছে। এগুলোর বৃত্তান্ত দেয়া আছে। এটাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এ বইতে আমার যে অভিব্যক্তি দল সম্পর্কে সেটা আমার ব্যক্তিগত। এটার সঙ্গে দলের কোন সম্পর্ক  নেই। যখন আমি বই লিখি তখন দলীয় ব্যক্তি হিসেবে বই লিখি না। আমি একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হিসেবে বই লিখি। সব বইতে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে দেশের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমাদের ব্যর্থতার যে সব কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো যদি অনুসরণ করি এবং চেষ্টা করি সংশোধন করতে তাহলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আবার ক্ষমতায় আসবে। এটাই মূল বার্তা। তিনি বলেন, আমার বাড়ির ব্যাপারে বলবো। বইটা লিখেছি অনেক আগে। যেহেতু আমি রাজনীতি করি, আমি বিরোধী দলের নেতা এবং বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আজকে আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করার জন্য সরকার একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ প্রক্রিয়া শুরু করেছে ২০১২ সালে। আর বইটা লেখা হয়েছে ৬/৭ বছর আগে। সুতরাং এটার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। বাড়ি বা সরকারকে সন্তুষ্ট করার প্রশ্নই উঠে না। আমার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা আছে। বাড়ির মামলা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। বইয়ের কোন মতামতের সঙ্গে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই।

No comments

Powered by Blogger.