ভয়, রহস্য, উদাসীনতাঘেরা স্তব্ধতা by ড. মাহফুজ পারভেজ

নোবেলজয়ী তুর্কি লেখক ওরহান পামুক তাঁর এক উপন্যাসে এমন একটি সমাজের চিত্র এঁকেছেন, যেখানে সবকিছু তুষারের, বরফের আচ্ছাদনে ঝাঁপসা, রহস্যময় এবং কুশাসন আর আতঙ্কের বাতাবরণে ঢাকা। এমন দুঃসহ সমাজ ভাবুক, কবি বা লেখকের কল্পনাতেই শুধু নয়, বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে না হলেও প্রতীকী অর্থে। হয়তো প্রাকৃতিক কারণে সত্যি সত্যিই বরফ ঝরছে না, তুষারে ছেয়ে যাচ্ছে না চারপাশ, তথাপি সবকিছু কেন যেন বড় বেশি রহস্যঘেরা। মনে হয়, অজানা, অদেখা, অদৃশ্য সুতোয় নাচছে সবকিছু। সবাই যেন বন্দি বা জিম্মি সেই ঘেরাটোপে। চোখের সামনে ঘটছে শত শত ঘটনা, দুর্ঘটনা, হত্যা, গুম, নির্যাতন, লুটপাট, অপরাধ; কিন্তু কারণ দেখা যাচ্ছে না। কার্য-কারণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। যাদের দায়িত্ব ঘটনার পেছনের কারণ খতিয়ে দেখা, তারাই এমন সব রহস্যঘেরা কথা বলছেন যে, পুরো বিষয়টিই হয়ে যাচ্ছে অধিভৌতিক। যেন অবাস্তব কিছু আমাদের পেছনে ধাওয়া করছে। এমন কথা সাগর-রুনি হত্যা থেকে মাওলানা ফারুকীর হত্যা কিংবা ইলিয়াস আলীর গুম থেকে নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার পর্যন্ত সকল ঘটনা বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সব ঘটনার পেছনেই ছড়ানো হচ্ছে ভয়-ভীতি, রহস্য-অতিকথন আর উদাসীনতা-গাফিলতির জাল। অথচ আমরা জানি যে, গণতান্ত্রিক সমাজ বা কার্যকর সুশাসন দাবি করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা। বিশেষত সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কাজে সব কিছুই হতে হবে স্বচ্ছ বা ট্র্যান্সপারেন্ট। সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে কাজের সাফল্য বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে। সর্বোপরি বিভিন্ন পদে আসীনদের নিজ নিজ কর্তব্য-কর্মে দায়িত্বশীল থাকতে হবে। বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। ঘটনার স্বচ্ছ বিবরণ যেমন নেই, তেমনি নেই ঘটনা সম্পর্কে জবাবদিহিতা এবং সে সম্পর্কে দায়িত্বশীল আচরণ। কোন চরম নাটকীয় বা বেদনাদায়ক ঘটনার পর পরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী থেকে নিম্নতর সংশ্লিষ্টদের কথা-বার্তা, বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই টের পাওয়া যায় চরম উদাসীনতা। কেউ যেন আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তদের দিতে পারছে না প্রকৃত আশ্বাস ও সাহসের বরাভয়। ফলে উপন্যাসের বরফ বা তুষারের  মতোই  চারদিকে বিরাজ করছে ভয়, রহস্য ও উদাসীনতাঘেরা স্তব্ধতা।
সামাজিক ও নাগরিক জীবন যদি ভয়, রহস্য ও উদাসীনতায় আক্রান্ত হয়, তাহলে গণতন্ত্র বা সুশাসনের দেখা পাওয়া যায় না। সাধারণ-স্বাভাবিক জীবন পর্যন্ত ব্যাহত হয়। ভয়ের বা রহস্যের ফলে নাগরিক সমাজে ও ব্যক্তি মানুষের মনে যে ট্রমা বা আঘাত বা ভীতির সঞ্চার হয়, সেটা জাতীয় উন্নয়নকেও স্থবির করে দেয়। মানুষ আতঙ্কে নীল হলে তার মেধা, মনন, যোগ্যতার পূর্ণ বিকাশ করতে পারে না। প্রায় প্রতিদিনই ঘরে-বাইরে খুন-হত্যা, গুমের পর মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির দিকটিই সবচেয়ে বেশি হয়। শিশুদের বিকাশ, নারী ও পুরুষের সুস্থ-স্বাভাবিক মানসিক জীবন তখন হয়ে যায় সুদূরপরাহত। ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিন-শাসনের লৌহ যবনিকার অন্তরালে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে মানসিক রোগাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সুদূর সাইবেরিয়ায় তখন অ্যাসাইলাম বা পাগলা গারদ খুলতে হয়েছিল সরকারকে। ট্রেন-ভর্তি মানসিক রোগী বা পাগলরা সাইবেরিয়ার অ্যাসাইলামে যাচ্ছে, সেটা ছিল সে আমলের এক অতি চেনা চিত্র। অথচ শরীরবৃত্তীয়ভাবে এসব লোক পাগলামির বীজাণু বা পাগলের বংশচক্র বহন করেন নি। তারা পাগল বা মানসিক ভারসাম্য হয়েছিলেন কুশাসনের আতঙ্কে, সামাজিক ভীতিতে, সন্ত্রাস ও অপরাধের তীব্রতায়। কেস স্ট্যাডিতে দেখা গেছে, কারো স্বামী বা পিতা বা সন্তানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরিয়ে দেয়া হয় নি। কাউকে কাউকে বিদেশী চর বলে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। অনেককেই রাষ্ট্র বা সরকারবিরোধী আখ্যা দিয়ে প্রতিনিয়ত ভীতি দেখানোয় লোকগুলো আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়েছিল। এক সময় তারা পাগল বা মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, উন্মাদ বা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে যায়। অতএব সমাজের মানুষের স্বাস্থ্য সব সময়ই যে রোগ-জীবাণুর কারণে নষ্ট হয়, তা নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান পরিবেশের কারণেও মানুষের মানসিক চাপ ও অসুখ সৃষ্টি হয়। বিশেষত প্রতিনিয়ত অপরাধ ও রক্তপাত দেখতে দেখতে মানুষের মনের কোণে ভীতির বীজ রোপিত হয়। অপরাধ ও অন্যায় প্রতিরোধের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষের ভীতি ও আতঙ্ক বাড়তে বাড়তে মহীরুহে পরিণত হয়। এই সুপ্ত মানসিক ভীতি ও আতঙ্ক বিরাট মনোরোগের কারণ। এসবই সামাজিক মনস্তত্ত্ব বা সোস্যাল সাইকোলজি-এর তাত্ত্বিক কথা। উন্নত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব এসব নিয়ে ভাবছে। তাদের নাগরিকদের নির্বিঘ্নে রাখার যাবতীয় রাষ্ট্রীয়-সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণ করছে। সেখানে সোস্যাল ও পারসোনাল সিকিউরিটির বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মতোই গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এখানে নিরাপত্তার সংজ্ঞাই যেন ভিন্ন। পথে-ঘাটে-বাড়িতে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও শান্তি  আছে কিনা, সেটাই দেখার প্রয়োজন বোধ করা হচ্ছে না। কে কাকে মারছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ধমকাচ্ছে, চোখ রাঙ্গাচ্ছে, তা নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা নেই। শক্তি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ আজ আর লুকিয়েও করতে হচ্ছে না। প্রকাশ্যেই দম্ভভরে নিজের অপকর্ম ও ক্ষমতা জাহির করাও সম্ভব হচ্ছে। যারা নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়েন, তারা প্রতিদিনের খবরেই এমন শক্তিমত্তার উদাহরণ দেখছেন। এসবের প্রতিক্রিয়ায় আরো দেখছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার তীব্র অভাব। এর ফলে চারদিকে ভয়, রহস্য ও উদাসীনতার স্তব্ধ আতঙ্ক। এ থেকে সমাজ যেমন রক্ষা পাচ্ছে না, ক্ষতির কবল থেকে বাঁচতে পারছে না মানুষ এবং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে টের পাওয়া যায়, কত নিম্নস্তরের সামাজিক ব্যবস্থা ও ভীতিপূর্ণ মানসিক অবস্থায় বসবাস করছে সাধারণ মানুষ। দুঃখ এটাই যে, কর্তা-পর্যায়ের যাদের এসব বিষয় লক্ষ্য করা ও প্রতিষেধকের ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তারাই শুধু চরম উদাসীনতা ও গাফিলতির জন্য এসব বিরাট ও সুদূরপ্রসারী মানবিক ক্ষতি দেখতে পাচ্ছেন না। তারা শুধু দেখছেন নিজেদের। নিজেদের কৃতিত্ব, উন্নতি ও আত্মপ্রশংসা। সমষ্টির পতনে ব্যক্তি বা দলের উন্নতি যে তুচ্ছ, এ সত্যটিও উপলব্ধি করতে পারছেন না, এটাই চরম বেদনার দিক।

No comments

Powered by Blogger.