কঠিন, অসাধ্য নয় by সাযযাদ কাদির

ঢাকা এখন যানজটের বিশ্বরাজধানী। কথাটা আমার নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার। বিশ্ববিখ্যাত শতবর্ষী মারকিন সাময়িকী ‘দ্য নিউ রিপাবলিক’-এর গত ২রা জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত সরজমিন প্রতিবেদনে বারলিনভিত্তিক সাংবাদিক-গবেষক মাইকেল হবস এভাবেই বর্ণনা করেছেন আমাদের রাজধানীকে। তাঁর প্রতিবেদনের  পুরো নাম ‘ওয়েলকাম টু দ্য ট্রাফিক ক্যাপিটাল অভ দ্য ওয়ার্ল্ড... হোয়াট আই লার্নড ফ্রম ক্রিপলিং গ্রিডলক ইন ঢাকা...’ (যানজটের বিশ্বরাজধানীতে স্বাগত... ঢাকার দুর্লঙ্ঘ্য যানজট থেকে যা কিছু জানলাম...)। তা কি জেনেছেন তিনি? নতুন কিছু নয়, যানজট নামের জানজটে যে চরম দুর্ভোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী সে সবেরই বর্ণনা দিয়েছেন, তুলে ধরেছেন দুঃসহ পরিস্থিতির কিছু ভীতিচিত্র। ঢাকাবাসীর সময় ও কাজের বিপুল অপচয় এবং শক্তি ও সামর্থ্যের অপূরণীয় ক্ষয়ের এ নাগরিক দুঃস্বপ্ন তো প্রতিদিনের। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মাইকেল। বলেছেন, ঢাকার অবয়ব কাঠামোর সঙ্গে সংগতি নেই জনসংখ্যার। পুরো শহরের মাত্র ৭ ভাগ রাস্তা। তুলনা করলে বলতে হয় প্যারিস ও ভিয়েনায় রাস্তার পরিমাণ ২৫ ভাগ, ওয়াশিংটন ও শিকাগোতে ৪০ ভাগ। ঢাকায় পরস্পর-সংযুক্ত রাস্তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় এমনিতেই কম, তার ওপর রয়েছে প্রধান-প্রধান রাস্তা সঙ্গে সংযোগ সড়কের অভাব। তিন-চার-পাঁচ রাস্তার বড়-বড় মোড় রয়েছে ৬৫০টি, কিন্তু ট্রাফিক লাইট আছে মাত্র ৬০টি- এর অধিকাংশই আবার অকেজো। ফলে যে অতি অল্প সংখ্যক পুলিশ আছে তাদের ওই মোড়ে-মোড়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়- রাস্তায় চলাচল তদারক বা বিধিবিধান প্রয়োগ করা হয় না।
মাইকেল লিখেছেন, ঢাকার যানজটে ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হয়েছে বছরে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাব বিলম্ব ও বায়ু দূষণ জনিত মাত্র, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম ও জীবন মানের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখানে নেই। আর এই যে দুর্বল অবয়ব কাঠামো- একে আরও দুর্বল ও চাপাক্রান্ত করে ঢাকা বেড়েই চলেছে প্রতিদিন। কারণ প্রয়োজনীয় রাস্তা ও পরিবহনের অভাবে উপকণ্ঠ এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারছেন না কর্মজীবীরা। ঢাকায় যাঁরা কাজ করেন তাঁদের থাকতে হচ্ছে ঢাকাতেই, উপকণ্ঠ এলাকায় থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জার হতে পারছেন না। নানা গতির নানা রকম যানবাহনের কারণও যে বিশেষ ভাবে দায়ী তা-ও বলেছেন মাইকেল। সবশেষে উপসংহার টেনেছেন এই কথা বলে যে গোটা সমস্যার মূল কারণ রাজনৈতিক। আর এ জন্যই সমাধান হচ্ছে না এসব সমস্যার। আর অদূর ভবিষ্যতে হবে এমন আশা একেবারেই সুদূরপরাহত। কারণ রাস্তা ও পরিবহনের সঙ্গে যারা যুক্ত- মালিক, শ্রমিক, চালক, দোকানি, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী- সবাই কোন না কোন দলের সঙ্গে, বিশেষ করে যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত। কাজেই কোন সংস্কার দূরে থাক আইনের তদারক বা প্রয়োগও সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় আইন দেখিয়ে টু পাইস কামানোটাই ভাল মনে করেন অনেকে। তারা তা করে থাকেন, করে চলেছেনও।
ঢাকার যানজট বুঝতে বেশি দূর যেতে হয় না আমার, প্রয়োজন পড়ে না তথ্য-গবেষণারও। আমার এই গ্রীন রোড (ফার্মগেট-ল্যাবএইড উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ)-এর অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারি বেশ।  প্রশস্ত রাস্তা, সুমসৃণ। মাঝখানে আইল্যান্ড। প্রশস্ত ফুটপাত, পাকা। কিন্তু সকাল আটটার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সময়ে যানজট লেগে প্রায়ই অচল থাকে, স্তব্ধ করে রাখে জনস্রোত। অথচ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক হিসেবে আশপাশের প্রধান রাস্তাগুলোর চাপ অনেকখানি সামলে দিতে পারতো গ্রীন রোড। তো এ রোডের যানজটের অবসান হতে পারে কিভাবে? এক, ফুটপাত থেকে দোকান ও বাজার সরাতে হবে। দুই, রাস্তার পাশের দোকান, গ্যারেজ, অবৈধ পার্কিং বন্ধ করতে হবে। তিন, কয়েকটি পুব-পশ্চিম রাস্তার ক্রসিংয়ে ঘুরপথ পরিবর্তন করতে হবে- এতে রং সাইড ধরে চলাচল বন্ধ হবে। তিনটি কাজই হয়তো কঠিন, কিন্তু অসাধ্য নয়। কিন্তু চেষ্টা করে দেখুন- সম্ভব হয় কিনা। যদি সম্ভব হয় তবে আরেকটি রাস্তা বেছে নিন এমন কাজের জন্য। তারপর নিন আরেকটা। তারপর আরেকটা। পাশাপাশি অন্যান্য যোগাড় যোগান চলুক। রাস্তার কমতি, বিশেষ করে পুবে পশ্চিমে, পূরণে করে চলুন একটি-একটি করে।

No comments

Powered by Blogger.