অপরাধীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতহীন ব্যবস্থা নিন by আলী ইমাম মজুমদার

‘অপরাধী অপরাধীই, তাদের বিচার হবে।’ কথাটি বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দশম সংসদে দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, দেশের আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থা স্থিতিশীল। এর মধ্যে তিনি ফেনী ও নারায়ণগঞ্জের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। দেশের সরকারপ্রধানের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। বিশেষ করে এ বক্তব্য যখন তিনি দেন জাতীয় সংসদের মতো স্থানে, তা অধিকতর তাৎপর্য বহন করে। গত মাস দুয়েকের মধ্যে এ দুটো স্থানে যে রোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, তার ন্যায়সংগত বিচার চায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজন। বিচার চায় গোটা দেশবাসী। সবাই চায় অপরাধীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনার প্রবণতা বন্ধ হোক।
নারায়ণগঞ্জ ঢাকা মহানগরের অদূরে শিল্পসমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এ দেশের শিল্পায়নের ইতিহাসে এ স্থান অগ্রণী। তবে ইতিমধ্যে জেলা শহরটি সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সাত খুনের ঘটনাটি ঘটে গত এপ্রিলের শেষে। প্রকাশ্য দিবালোকে শহরের রাজপথ থেকে সাতজন লোককে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর কয়েকজন সহযোগী, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার আর দুজন গাড়িচালক। কয়েক দিন পর শীতলক্ষ্যায় পাওয়া যায় তাঁদের মৃতদেহ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের হয়।

পরবর্তী সময়ে তৎপরতা যত জোরদার হোক, সূচনাতে অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বেরিয়ে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রথমে অভিযোগ আনেন নিহত নজরুলের শ্বশুর। তাঁর বর্ণনামতে, নূর হোসেন ছয় কোটি টাকা দিয়ে স্থানীয় কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তার মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ঘটনার পরও নূর হোসেন দিন তিনেক দেশেই ছিলেন। টেলিফোনে কথা বলেছেন সাংসদ শামীম ওসমানের সঙ্গে। ঘটনাটির নৃশংসতা ও অভিনবত্বে সব মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তিনজন র্যাব কর্মকর্তাকে সামরিক বাহিনীতে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে করা হয় কর্মচ্যুত। উচ্চ আদালতের আদেশে তাঁরা গ্রেপ্তারও হন। জানা যায়, তাঁরা তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন পালিয়ে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন ভারতে। সেখানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বলা হচ্ছে, শিগগির তাঁকে ফেরত আনা হবে। সে ক্ষেত্রে এ মামলার তদন্ত শেষ হতে তেমন সময় লাগার কথা নয়। উল্লেখ্য, তার পরও নারায়ণগঞ্জে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদের একটি আসনে উপনির্বাচন শেষ হওয়ার পরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে শামীম ওসমান বলেছেন, র্যাব এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাহলে সব মিলিয়ে এ ঘটনায় তাঁর অন্য কোনো ভূমিকা ছিল কি না, এটা তদন্তের বিষয়। আর কিছু না হলেও তিনি যে একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, এতে সন্দেহ নেই। অথচ আজ অবধি তাঁকে তদন্তকারী সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা যায় না। এমনকি হাইকোর্টের আদেশে গঠিত কমিটিও তা করেছে, এমনও শোনা যায়নি। সে ক্ষেত্রে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ চিত্র আসবে কীভাবে? যতটুকু জানা গেছে, এ খুনের মূল উদ্দেশ্য অবৈধ চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। উল্লেখ্য, পক্ষ দুটোই শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
ওসমান পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ সেখানকার ত্বকী হত্যা মামলায় মূল অভিযুক্ত। এ পরিবারেরই একজন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদ উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ বিষয়ে বহু অভিযোগ এসেছে। ভোট গ্রহণের দিনে অনিয়মের অংশীদার হতে অস্বীকার করায় একজন তরুণ এএসপিকে সাংসদ শামীম ওসমান অশালীন ভাষায় হুমকি দেন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই কর্মকর্তা ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। গণমাধ্যমে তিনি ব্যাপকভাবে নন্দিত হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে হুমকির মুখোমুখি হওয়া এই কর্মকর্তার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন নীরব। প্রকৃতপক্ষে এ হুমকি দায়িত্ব সম্পাদনে বাধাদানের নামান্তর। তবু তারা নির্বিকার। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে এক্স-রে করেও নাকি কোনো মেরুদণ্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ এ বিষয়ে আর মন্তব্য না করাই ভালো।
এ নির্বাচনে তাঁর ভাইয়ের প্রশ্নবিদ্ধ বিজয়ের পরপরই সাংসদ শামীম ওসমান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে দায়ী করেছেন কদর্য ভাষায়। তাঁর পরিবারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের জন্য দায়ী করেছেন তাদের। নারায়ণগঞ্জে তাঁদের পিতা-পিতামহ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। সে ভূমিকা ক্ষুণ্ন করছেন তাঁদের বংশধরেরাই—এমনটি বললে মোটেই অসংগত হবে না। তা আমলে না নিয়ে প্রশাসন, পুলিশ, গণমাধ্যম সবাইকে হুমকি–ধমকির মাধ্যমে তিনি কাবু করতে চাইছেন। তাই আলোচিত সাত খুনের মামলাটির পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশস্ত হওয়া কঠিনই বটে।
এরপর আলোচনায় আসে ফেনী প্রসঙ্গ। দীর্ঘকালের সমৃদ্ধ ও বহু খ্যাতনামা লোকের জন্মস্থান এ জেলা। অথচ আজ প্রায় দুই যুগ যেন মাঝেমধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নেয়; অনেকটা লেবাননের বৈরুতের মতো। এক গডফাদার মঞ্চ ত্যাগের পর মনে হয়েছিল ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। গত মে মাসের শেষ দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে ফেনী শহরের বুকে সরকারি গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামকে। মৃতদেহসহ গাড়িটি অকুস্থলেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ হত্যাকাণ্ডে ৩৫ জন অংশ নেয় বলে খবরে প্রকাশ। এর মধ্যে মূল চারজনের তিনজনই শাসক দলের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। কেউ কেউ স্থানীয় সাংসদ নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। নিজাম হাজারী ঘটনার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন। আর ফুলগাজী আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ দায়ী করতে থাকে নিজাম হাজারীকে। সবারই জানা, সাংসদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উভয়ই শাসক দলের লোক।
অভিযোগ রয়েছে, নিজাম হাজারী একটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবাসের মেয়াদ শেষ না করেই কাগজপত্র জালিয়াতি করে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। জানা যায়, এ খবর ফাঁস করে দিয়েছিলেন নিহত একরাম। নেতৃত্বের গণ্ডি আর চাঁদাবাজি নিয়ে উভয় নেতার মধ্যে তীব্র রেষারেষি চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এ বিষয়ে ফেনীতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিজাম হাজারী দাবি করেন, জয়নাল হাজারী ঘটনা সম্পর্কে জানেন। তাঁকে রিমান্ডে নিলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। জয়নাল হাজারীও প্রত্যুত্তরে ঘটনার জন্য নিজাম হাজারীকে দায়ী করেন। তদন্ত চলছে। তবে সন্দিগ্ধ ব্যক্তি কিংবা সাক্ষী যেটাই হোক, নিজাম হাজারীকে এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা যৌক্তিক; এমনকি জয়নাল হাজারীকেও। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা কি তা করতে পেরেছে? যারা প্রত্যক্ষভাবে ঘটনাটি ঘটায়, তারা দায়ী হবে নিশ্চয়ই। তবে তাদের নেপথ্যে কোনো বড় শক্তির অবস্থানের সম্ভাবনা নাকচ করার সুযোগ নেই। এদের আইনের আওতায় না আনতে পারলে তদন্ত থাকবে অসম্পূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আইন চলবে নিজস্ব গতিতে। তাহলে প্রশ্ন থাকে, এ ধরনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীদের কেউ না কেউ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনা দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিতে হয় কেন? নারায়ণগঞ্জের ঘটনা নিয়ে তদন্ত পর্যায়ে কেন হাইকোর্টের আদেশ আবশ্যক হয়? ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দুজন প্রতিশ্রুতিশীল কর্মী সাগর আর তাঁর স্ত্রী রুনি হত্যাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হয়তো বা এত দ্রুত তা করা সম্ভব নয়। তবে ২৪ মাসেও এ রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়টি চাপা পড়ে থাকার বিষয়কে কি গ্রহণযোগ্য বলা চলে? ঠিক তেমনি নারায়ণগঞ্জেরই কিশোর ত্বকী হত্যার এক বছর পার হলেও অভিযোগপত্রও এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এখানে সরকারের কোনো কোনো মহলের সদিচ্ছা সম্পর্কে কেউ সংশয় প্রকাশ করলে তাকে কি খুব দোষ দেওয়া যাবে?
নারায়ণগঞ্জ আর ফেনী দুটো ভিন্ন জনপদ। আলোচিত ঘটনাও ভিন্ন। অপরাধের ধরন অভিনব ও ভয়াল। বিচারে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু এসেছে, তাতেই দেশবাসী বিস্মিত ও বিমূঢ়। প্রধানমন্ত্রী সংসদে এ বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, আমরা বাস্তবে তার দ্রুত প্রতিফলন দেখতে চাই। এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধীদের প্রতি সরকারকে কঠোর হতে হবে। তদন্তের স্বাভাবিক গতিকে কেউ যেন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। পক্ষপাতহীনভাবে অপরাধীকে শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারলে বলা যাবে আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থা স্থিতিশীল।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.