নারায়ণগঞ্জে কে জিতবে—শান্তি না সন্ত্রাস? by সোহরাব হাসান

গুম-খুনের জনপদ নারায়ণগঞ্জে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রহিত হয়নি, তার প্রমাণ গত শুক্রবার সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের নেতা-কর্মীদের ওপর সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলা। ত্বকী মঞ্চের নেতা-কর্মীরা ২৬ জুনের উপনির্বাচনে নিজেদের বক্তব্য লিফলেট আকারে প্রচার করছিলেন। সেই লিফলেট প্রচার যদি নির্বাচনী আচরণিবধি লঙ্ঘন করে থাকে, সেটি দেখবেন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। আর কোনো প্রার্থী বা তাঁর সমর্থকেরা যদি মনে করেন, এই লিফলেট প্রচারের মাধ্যমে তাঁদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে, তাঁরা নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে লিফলেট প্রচারকারীদের ওপর হামলে পড়ার কী কারণ থাকতে পারে? আরও উদ্বেগজনক হলো, এই হামলার ঘটনাটি ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব কি হামলাকারীদের উসকানি দেওয়া, না আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো?

এখন দেখা যাক, সন্ত্রাসবিরোধী ত্বকী মঞ্চের নেতা-কর্মীদের লিফলেটে কী ছিল? লিফলেটে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে িক তাঁরা কোনো বক্তব্য রেখেছেন? না। লিফলেটে লেখা ছিল: ‘তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর সকল হত্যাকারীর ফাঁসি চাই। ভোট আপনার পবিত্র আমানত। আপনার সন্তান ও শিশুদের কথা ভেবে অন্তত খুিন ও সন্ত্রাসী পরিবারের কাউকে ভোট দেবেন না।’
এই লিফলেটে কোনো প্রার্থীর নাম বলা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘খুিন ও সন্ত্রাসী পরিবারের কাউকে ভোট দেবেন না।’ এখন যারা হামলা করেছে, তারা কি নিজেরাই সেই খুিন ও সন্ত্রাসী পরিবারের দায় স্বীকার করে নিল না?
আমরা ধারণা করেছিলাম, সাত খুনের ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জে আর কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটবে না। গডফাদার-মাস্তানদের উৎপাত চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনা প্রমাণ করল, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। কুকুরের লেজ যতই সোজা করা হোক না কেন, সুযোগ পেলেই সে লেজ বাঁকা করবেই।

২.
২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচন। এই নির্বাচনের দুই প্রধান প্রার্থী এস এম আকরাম ও সেলিম ওসমান। এস এম আকরাম ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দিয়ে তাঁকে জিতিয়ে এনেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ‘শামীম ওসমানদের সঙ্গে রাজনীতি করা যায় না’ বলে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন িতনি পাবেন। যেমনটি সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছিলেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে৷
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হলেন প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমান। তিনি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিতে নবাগত।
দুই প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের হলফনামায় যেসব তথ্য দিয়েছেন, তার প্রতি আমরা একবার আলোকপাত করতে পারি।
এস এম আকরাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছেন। তা ছাড়া তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিিগ্রও নিয়েছেন৷ নিজের এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয়ের উৎস কৃষি খাত থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ১২ লাখ টাকা, বাড়ি-দোকান ভাড়া থেকে তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় দুই লাখ ১৪ হাজার টাকা, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত থেকে তাঁর নিজের বার্ষিক আয় তিন লাখ ৩৭ হাজার ৫৪১ টাকা। তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয় আট লাখ ৫৮ হাজার ৮১৬ টাকা। পরামর্শক হিসেবে তাঁর বার্ষিক আয় ১৯ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪ টাকা। চাকিরর পেনশন থেকে বার্ষিক আয় এক লাখ ৯৮ হাজার ২৮২ টাকা।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আকরামের নিজের নামে নগদ আট লাখ ৩৫ হাজার ৫৫০ টাকা, স্ত্রীর নামে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৪২৫ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ নিজের নামে এক কোটি ২২ লাখ ৮৪ হাজার ৯১২ টাকা, স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭৩৬ টাকা, বন্ড-ঋণপত্র-স্টক এক্সচেঞ্জের কোম্পানির শেয়ার নিজের নামে ছয় লাখ ৩৪ হাজার ২০০, স্ত্রীর নামে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৮০০, পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ নিজের নামে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে এক কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ২৪৪ টাকা, নিজের নামে ১০ লাখ টাকা মূল্যের এবং স্ত্রীর নামে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমি নিজের নামে ৫০ হাজার টাকার, স্ত্রীর নামে দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকার, স্ত্রীর নামে ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ৮১২ টাকার দালান, নিজের নামে চা-রাবার বাগান, মৎস্য খামারের মূল্য দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা। তাঁর নামে কোনো ব্যাংকঋণ নেই।
এস এম আকরাম উল্লেখ করেছেন, ১৯৯৬-২০০১ সময়ে তিনি এই আসনের সাংসদ থাকাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার-উন্নয়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করেছিলেন।
সেলিম ওসমান উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত ফৌজদাির মামলার কার্যক্রম বর্তমানে হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত তিনটি ফৌজদারি মামলার মধ্যে দুটি রাষ্ট্রের আবেদনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, একটিতে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। ফতুল্লা থানায় দায়ের করা মামলাটিও রাষ্ট্রের আবেদনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
সেলিম ওসমান তাঁর ব্যবসা উল্লেখ করেছেন উইজডোম অ্যাটায়ার্স লি., উইজডোম ফেব্রিক্স (প্রা.) লি., উইজডোম নিটিং মিলস লি. (নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক), ফাইফ স্টার ফার্ম হাউস লি. ও ফাইফ স্টার ফার্ম হাউস (ডেইরি, কৃষি ও মৎস্য)।
কৃষি ও মৎস্য খাতে সেলিম ওসমানের নিজের বার্ষিক আয় ২৮ লাখ টাকা, স্ত্রীর ৬৮ লাখ টাকা, বািড়-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ভাড়া থেকে মেয়ের বার্ষিক আয় তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি বার্ষিক সম্মানী পান ৪৮ লাখ টাকা, স্ত্রী পান ৪২ লাখ টাকা, মেয়ে পান ২৪ লাখ টাকা। শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের সুদ থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ছয় লাখ ৬০ হাজার ৪৮৬ টাকা, স্ত্রীর আয় ৪১ হাজার ৩১৭ টাকা, মেয়ের আয় ৯৪ হাজার ৯৭ টাকা।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে সেলিম ওসমানের নিজের নামে ২৮ মে পর্যন্ত নগদ চার কোটি ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫৭১ টাকা, স্ত্রীর নামে দুই কোটি ৬৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৭৫ টাকা, মেয়ের নামে ২১ লাখ ৬৮ হাজার ৯১০ টাকা রয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত টাকার পরিমাণ ২৮ মে পর্যন্ত নিজের নামে ৫১ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৭ টাকা, স্ত্রীর নামে ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯৬ টাকা, মেয়ের নামে পাঁচ লাখ ৮৩ হাজার ৫২১ টাকা।
বন্ড, ঋণপত্র, কোম্পািনর শেয়ার নিজের নামে উইজডোম অ্যাটায়ার্স লিমিটেডে সাড়ে সাত লাখ টাকার শেয়ার, উইজডোম নিটিং মিলস লিমিটেডে দুই লাখ টাকার শেয়ার, উইজডোম ফেব্রিক্স লিমিটেডের ১৯ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে নিজের নামে বিনিয়োগ আইএফআইসি ব্যাংকে ৬১ লাখ ৫৯ হাজার ১৮ টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা, স্ত্রীর নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা, মেয়ের নামে এক কোটি টাকা। নিজের নামে ৩২ লাখ টাকা মূল্যের িজপগািড়, স্ত্রীর নামে ১২ লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেট কার রয়েছে।
অকৃষি জমি ফতুল্লার দাপা ইদ্রাকপুরে নিজের নামে ২৬ শতাংশ খালি জমি (মূল্য ১০ লাখ ৬১ হাজার টাকা), স্ত্রীর নামে একই এলাকায় ২৯ শতাংশ খালি জমি (মূল্য ৯৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা), স্ত্রীর নামে ফতুল্লার ইসদাইরে ২৭ শতাংশ খালি জমি (মূল্য সাত লাখ টাকা)। নগরের উত্তর চাষাঢ়ায় ৯ শতাংশ জমি ওপর সেলিম ওসমানের নামে তিনতলা বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য এক কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
ঢাকার ৫৪ নম্বর ইনার সার্কুলার রোডে শেল্টে্ক ১/এ অ্যাপার্টমেন্টটি সেলিম ওসমানের নামে, মূল্য ১৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। ধানমন্ডির বাড়ি নম্বর ১/বি, রোড ১৩/১-এ চার হাজার ২৮৬ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট তাঁর স্ত্রীর নামে (মূল্য ৩৯ লাখ অাট হাজার টাকা)। ৯৩/বি ধানমন্ডিতে তাঁর মেয়ের নামে দুই হাজার ৬৩৩ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট আছে (মূল্য ৩০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা)।

৩.
দুই প্রার্থীর এই হলফনামায় স্পষ্ট যে, এস এম আকরাম সরকারি চাকরি ও রাজনৈতিক জীবনে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই৷ তিনি যা করেছেন নিজের মেধা ও পরিশ্রমে৷ আর সেলিম ওসমানের রাজনৈতিক পঁুজি হলো ওসমান পরিবার, যার ইতি-নেতি দুটি দিকই আছে৷ একদা ঐতিহ্যবাহী এই পরিবারটির সুনাম ধ্বংস করেছেন পরিবারের সদস্যরাই৷ নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে, সব সন্ত্রাস, মাস্তানি ও চাঁদাবাজির পেছনে ওসমান পরিবারের সম্পৃক্ততা আছে৷ সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে রাজনীতিতে এনেছেন নাসিম ওসমান আর তাঁর হাত শক্তিশালী করেছেন শামীম ওসমান৷ এমনকি সাত খুনের পর যখন পলাতক নূর হোসেন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শামীম ওসমানের সাহায্য চাইলেন, তিনি তাঁকে পাসপোর্টে সিল আছে কি না, জানতে চাইলেন৷ হ্যাঁ, নূর হোসেনের পাসপোর্টে সিল ছিল এবং তিনি কলকাতায় পালিয়েও গেলেন৷ ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ রুটে চাঁদাবাজি করে কারা কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছে, নারায়ণগঞ্জে যেকোনো ব্যবসা বা উন্নয়নকাজ করতে হলে কাদের মোটা অঙ্কের সালামি দিতে হয়, তা–ও কারও অজানা নয়৷
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, নারায়ণগঞ্জে কি এসব খুন, গুম, চাঁদাবাজি, সালামির ঘটনা ঘটতেই থাকবে, না শান্তি আসবে? নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, নির্ভয়ে ভোট দিতে পারলে তাঁরা শান্তির পক্ষেই রায় দেবেন৷ যেমনটি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে৷
ইতিমধ্যে এস এম আকরাম সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁর আশঙ্কা, প্রতিপক্ষ দ্বারা নির্বাচনী কেন্দ্র ও ভোটের বাক্স দখল হয়ে যেতে পারে। নির্বাচন যাতে সুুষ্ঠুভাবে হয়, কেউ যাতে ভোটকেন্দ্র দখল বা বাক্স ছিনতাই করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরই৷ যদি তাঁরা এই চ্যালেঞ্জটি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারেন, তাহলে সেখানে শান্তিরই জয় হবে৷ আর যদি না পারেন, সন্ত্রাসই জিতে যাবে, যার প্রাথমিক মহড়া শুক্রবার সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের ওপর হয়ে গেল৷

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.