ভারত ও কংগ্রেস- সব শেষ হয়ে যায়নি by শশী থারুর

ভারতের গত মাসের সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি ও নরেন্দ্র মোদির জয় দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও করপোরেটতন্ত্রের আস্থা অর্জন করায় মোদি এ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এতে কি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও গণতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘরানার আর্থসামাজিক ধ্যানধারণার দিন শেষ হয়ে গেল?

এই ‘নেহরু ঘরানার ঐকমত্যে’র কারণে ভারতের গণতান্ত্রিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। নানামুখী প্রবণতাকে এক সূত্রে গাঁথা সম্ভব হয়েছে। ফলে ভারত কোনো একক গোষ্ঠীর হাতে বন্দী হয়ে পড়েনি। নেহরু ঘরানার সমাজতন্ত্রকে গালি দেওয়া এখন রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে৷ এর ফলে নাকি বহুদিনের জন্য ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই আক্রমণের শানে-নজুল হচ্ছে ভারতের মতো একটি চরম দরিদ্র ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রে সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষদের উন্নয়নের আওতার বাইরে রাখা৷ অন্য কথায়, এই শ্রেণির মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত সরকারি নীতির সমালোচনা করা।
সরকারি মালিকানার কাঠামো তৈরি এবং সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠাই ছিল নেহরুর এই নীতি বাস্তবায়নের সবচেয়ে কার্যকর উপায়৷ একই সঙ্গে সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো। হ্যাঁ, নেহরুর নীতিতে ভুল ছিল। এই নীতির কারণে তথাকথিত ‘লাইসেন্স-পারমিট-কোটারাজ’ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়, এর ফলে সরকারি নিয়ন্ত্রণ উদ্যোক্তাদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় ভারতের প্রবৃদ্ধির হার কম।
১৯৮০-এর দশকে নেহরুর নাতি রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি এরূপ অনেক বোঝাস্বরূপ আইন বাতিল করেন। তারপর কংগ্রেস নেতা নরসীমা রাও ও মনমোহন সিং যুগল যে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন, তাতে ভারত এক নতুন উৎকর্ষের যুগে প্রবেশ করে। আর আর্থসামাজিক জীবনধারায়ও গতি আসে।
কিন্তু ভুলটা আসলে কোথায়? অনেকেই বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই বছর শ্লথ থাকায় তরুণদের মধ্যে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, মোদি সেটা কাজে লাগাতে পেরেছেন। সমালোচকেরা বলছেন, কংগ্রেস ঠিক এখানেই মারটা খেয়েছে—দলটির নজর ছিল ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের ওপর।
কংগ্রেস যদি বলে তারা নেহরুর সময়ে নির্মিত অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর ভর করে এগিয়েছে, আবার একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আইন বাতিল করেছে, তাহলে সেটা অযৌক্তিক হবে না। কিন্তু দলটি সব সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে হেঁটেছে, যার ভিত্তি হচ্ছে ভারতের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নেরও সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারটি তরুণদের কাছে পাত্তা পায়নি, তারা সব সময় এখানে-সেখানে উন্নয়ন খুঁজে বেড়ায় কিনা।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কংগ্রেস ভোটারদের কাছে তার এই মূল্যবোধের কথা আরও ভালোভাবে পৌঁছে দিতে পারত। কংগ্রেস টানা ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল, ফলে দলটির বিরুদ্ধে জনরোষও সৃষ্টি হয়েছিল—বিজেপির এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে এটাও কাজ করেছে। আর মোদি নিজেকে পরিবর্তনের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারায় বিজেপি একদম বাজিমাত করে ফেলে।
অনেকেই দাবি করেন, নেহরুর আমলের সেই জাতীয় ঐকমত্য ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তাঁরা এও বলেন, কংগ্রেস জনগণের ভাষা বুঝতে পারেনি৷ জনগণ নাকি অর্থনৈতিক উন্নয়নই চায়, সামাজিক বৈধতা নয়। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, বিগত দুই বছর বাদ দিলে কংগ্রেসের শাসনামলে ভারতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী ও সমাজকর্মীদের সহযোগিতায় আমরা চেয়েছিলাম, এই উন্নয়নের সুফল আরও সুষমভাবে বণ্টন করতে। এতে কিছু সফলতাও এসেছিল। ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, বিগত ১০ বছরে ভারতীয় জনগণের জীবনমান উন্নত হয়েছে।
কংগ্রেস সরকার সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশিসংখ্যক শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে পেরেছে, আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে কাজে নিয়োগ দিতে পেরেছে এবং একই সঙ্গে তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে। যে কারণে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়, তা আদতে সেই সর্বহারা মানুষদের নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে এবং তাঁদের জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করেছে।
অনেকে বলছেন, কংগ্রেস নিজেকে বিজেপি থেকে আলাদা করার জন্য সমাজতান্ত্রিক পথে হাঁটবে; কিন্তু সেটা তার জন্য বুমেরাং হতে পারে। কারণ, ভোটাররা নাকি সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিহার করেছেন। কিন্তু যে দেশের প্রতিটি নির্বাচনী আসনে বেশির ভাগ মানুষ দিনে দুই ডলারের চেয়ে কম আয় করেন, সেখানে গরিবমুখী নীতি পরিহার করা তেমন বিচক্ষণ কাজ নয়। কংগ্রেস নেতাদের উচিত হবে সব সময় এ বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া যে তাঁদের আমলে ভারতীয় জনগণের জীবনমান উন্নত হয়েছে৷ আর জনগণের হাতে তথ্য আসার কারণেই তাঁরা সরকারের কাছে নতুন ও ভিন্ন দাবি জানাতে পারছেন।
হ্যাঁ, আমরাও উন্নয়ন চাই৷ তবে সেটা সবচেয়ে দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাক, সেটাও আমরা চাই। পরিণামে এই নেহরু ঘরানার উন্নয়ন মডেলই টিকে যাবে৷ কারণ, সেটা অধিকাংশকে বাদ দিয়ে গুটি কয়েক মানুষের উন্নয়নে বিশ্বাস করে না।
হ্যাঁ, ভারতকে চকচকে হতে হবে। আর তাকে চকচকে হতে হলে অধিকাংশ মানুষের জীবন রাঙিয়েই তা হতে হবে। মোদি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারেন, তাহলে তাঁর এই জয় হবে ক্ষণস্থায়ী, আর নেহরুপন্থীরাই আবার ফিরে আসবেন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.