শুদ্ধ আওয়ামী লীগ চাই, হাইব্রিড নয়

একেবারে দলকানা অথবা স্তাবক না হলে সবাই স্বীকার করবেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে একধরনের সংকটকাল অতিক্রম করছে। আমার এই মন্তব্যে অনেকে ক্ষুব্ধ হতে পারেন, তার পরও সত্য কথাটি না বললে নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী মনে হবে। প্রতিদিন সকালে যখন পত্রিকার পাতা খুলি আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে দিনের বেলায় খুনের খবর পড়ি; তখন স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের অবস্থার কথা মনে পড়ে যায়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াত আর ইসলামী ছাত্র সংঘের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। তারা কৌশলে তখন লেবাস পাল্টে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল), পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। এসব দলই ছিল গলাকাটা রাজনীতির প্রবক্তা। গঠিত হয় জাসদ আর গণবাহিনী। অনেকে সেখানে গিয়েও ভিড় করে। এরা সবাই জোটবদ্ধ হয়ে তখন শুরু করে দেশের ভেতর নানা ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বেপরোয়াভাবে হত্যা। আজ এই পাটের গুদামে আগুন লাগে তো কাল ওই নেতাকে হত্যা করা হয়। এই সময় সবচেয়ে ভয়াবহ অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনাটি ছিল ঘোড়াশাল সার কারখানার কন্ট্রোল রুমে বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে কারখানার শুধু ব্যাপক ক্ষতিই হয়নি, একই সঙ্গে নিহত হন বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আবদুল হক ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে চিঠি লিখে তাঁর কাছে শেখ মুজিবকে উৎখাত করার জন্য অর্থ, অস্ত্র ও বেতারযন্ত্র সহায়তা চান, যা ভুট্টো তাঁর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য পাঠিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের হাতে দলের প্রায় ৭০ জন নেতা-কর্মী নিহত হন, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন সাংসদও ছিলেন। পরিস্থিতি দ্রুত ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকে। একটি নতুন অনভিজ্ঞ সরকারের জন্য এটি ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসবের প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন, যাঁদের সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এঁদের অনেকেরই নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যাওয়ার নির্ধারিত যোগ্যতার ঘাটতি ছিল। বঙ্গবন্ধু মনে করেছিলেন, এঁদের আধা সামরিক বাহিনীর আদলে গড়ে তুলে দেশের ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে কাজে লাগাবেন। কিন্তু এই কাজে তিনি খুব বেশি সফল হয়েছিলেন তা বলা যাবে না। ইদানীং রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে অনেক সমালোচনা শোনা যায়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যকে জেনারেল জিয়া নিয়মিত সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করেন৷ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হলেও বর্তমানের ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সারা দেশে সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে নিজেরাই নিজেদের খুন করছে।বাদ যাচ্ছে না ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রলীগ খুন বা যুবলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, পাবনা, রাজশাহী—কোনো অঞ্চল বা জেলা বাদ যাচ্ছে না। নিজেদের মধ্যে এই হানাহানির সুযোগ নিচ্ছে প্রধানত জামায়াত-শিবির। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে তারা ছাত্রলীগের একজন নেতার পায়ের গোড়ালি কেটে দুই টুকরা করে দিয়েছে, তার নৃশংসতা নজিরবিহীন। সার্বিক বিচারে এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, আওয়ামী লীগ নামক দলটির অস্তিত্ব এখন অনেকটা হুমকির মুখে।
দলের প্রধান শেখ হাসিনাই এই দলটির হাল ধরে রেখেছেন। সম্প্রতি আমার সুযোগ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে তাঁর সঙ্গে জাপান যাওয়ার। তাঁর এই সফর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সফল, কথাটি যাঁরা অস্বীকার করবেন, বলতে হয় তাঁরা শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতাই করছেন অথবা তাঁদের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা কাজ করে। যাত্রার আগে ও বিমানের ভেতরে অনেকে আমাকে বলেছেন, ‘একজন শেখ হাসিনা দেশের জন্য কত কষ্ট করেন, কিন্তু তাঁর সব অর্জন মুহূর্তেই ধূলিসাৎ করে দেন তাঁর নিজ দলেরই কিছু অপরিণামদর্শী নেতা-কর্মী, স্রেফ ব্যক্তিস্বার্থে। তাঁর চারপাশে যাঁরা তাঁকে ঘিরে থাকেন, তাঁরা কতটুকু তাঁর বা দলের মঙ্গল চান তা কি তিনি ভেবে দেখেছেন?’ দেশে ফেরার পর অনেকে জানতে চান, এই প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনো কথা হয়েছে কি না। বলি, তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। এঁরা সবাই যে সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তা নয়, কিন্তু তাঁরা শেখ হাসিনার বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁরা তাঁর সরকারের বিকল্প দেখছেন না। এঁদের প্রায় কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। পটুয়াখালী থেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক ফোন করে জানান, তাঁর বয়স ৮৫। তিনি সেই বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দলটি কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হোক, দেখতে চান না। তাঁর মতে, এক ছাত্রলীগই এই দলটির সর্বনাশ করছে। তাঁকে বলি, যারা এই কাজটি করছে তারা ছাত্রলীগ নামধারী দুর্বৃত্ত।ছাত্রলীগের আদর্শে বিশ্বাস করে তেমন কোনো ব্যক্তি এমন আত্মঘাতী কাজ করতে পারে না। সেই স্কুলশিক্ষক তার পরও অনুরোধ করেন, আমি যেন এই দুর্বৃত্তদের কথা লিখি। তাঁকে বলি, ছাত্রলীগ নিয়ে কিছু লিখতে চাই না কারণ,
এতে তেমন কোনো কাজ হয় না। একবার লিখেছিলাম। ফল হয়েছিল, তারা আমাকে আমার আগের কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল। সুযোগ পেলেই নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর আর পাবনার কথা সবাই বলেন। বলেন, এসব এলাকার ‘গডফাদারদের’ দল থেকে বহিষ্কার করলে দলের কোনো ক্ষতি নেই। একই সঙ্গে ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নামধারীদের লাগাম টেনে ধরলে সাধারণ মানুষের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। বাস্তবে আওয়ামী লীগের এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের মতের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে সভানেত্রী একাধিকবার বলেছেন দলের ভেতরে, বিশেষ করে ছাত্রলীগে অনেক জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এর ফলে মূল দল এবং ছাত্রলীগ উভয়ই হাইব্রিড ‘নেতা-কর্মী’ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছে৷ এর দায়-দায়িত্ব তো একান্তভাবে দলকেই নিতে হবে। বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জামায়াতের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। তারা চাইবেই যেভাবে হোক তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এবং দলের ক্ষতি করার জন্য আওয়ামী লীগের ভেতরে অনুপ্রবেশ করতে। এই পরিস্থিতিতে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সতর্ক হওয়ার বদলে অনেককে দেখা যাচ্ছে, তাদের ফুলের তোড়া দিয়ে সাদরে দলে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এই নেতারা নিশ্চয় এত বোকা নন যে এটা বুঝতে অক্ষম—কেউটে সাপের বাচ্চা কেউটে সাপই হয়। দলের জন্য এমন একটি কাজ যে চরম আত্মঘাতী, তা বোঝার জন্য কোনো বড় মাপের নেতা হওয়ার তো প্রয়োজন নেই। এরই মধ্যে আবার শুরু হয়েছে জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা নিয়ে আইনমন্ত্রীর দেওয়া একটি বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা। এমনিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচারের রায় প্রকাশে বিলম্বের কারণে কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি আর সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তার ওপর জামায়াতের বিচার নিয়ে আইনমন্ত্রীর এই অপ্রয়োজনীয় উক্তি। পরিস্থিতিকে আরও একটু ঘোলাটে করে দিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাঁর মিন্ত্রসভার সদস্যকে সমর্থন করলেন।
এসবের কোনোটাই প্রয়োজন হতো না, যদি আইনমন্ত্রী বিষয়টা নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য না করতেন। দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার অনেক আইন আছে। একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ঠিকই জানেন কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সরকারের আইনমন্ত্রী তাঁর বাবার মতো একজন প্রথিতযশা আইনজীবী, কিন্তু এখনো সম্ভবত তিনি একজন রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে পারেননি। গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিপক্ষ বানানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। এর ফলে সাধারণ মানুষ ভুল সংকেত পাচ্ছে। এসব থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যই ক্ষতির কারণ। এসব বিষয় কেবল একজন শেখ হাসিনাকে বুঝলে হবে না, বুঝতে হবে দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে। সাধারণ মানুষের অনেককে বলতে শুনেছি, তাঁরা ‘বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে’ ফেরত চান। তাঁদের বলি, চাইতে দোষ নেই, কিন্তু তা কতটুকু পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে দলের অর্বাচীন নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে শেখ হাসিনা কতটুকু কঠোর হতে পারেন তার ওপর৷ তাঁদের অভয় দিয়ে বলি, সাম্প্রতিক কালে শেখ হাসিনা কিছু কিছু ব্যাপারে একাধিক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনিই দলকে সঠিক পথে আনতে পারেন। এরই মধ্যে মঙ্গলবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হলো। সেই সভায় তিনি সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সব পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন।হুঁশিয়ার করেছেন দলের অর্বাচীন নেতা-কর্মীদের। এই কাজ তিনি আগেও করেছেন, কিন্তু তা তেমন একটা কাজে আসেনি। দলের সাধারণ সম্পাদকের এলাকায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে কোনো কাউন্সিল হয় না বলে আমাকে বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন। পরিস্থিতি যদি তেমনটা হয়, তাহলে দলের অবস্থা তো দুর্বল হবেই। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার চেয়ে দলে সময় দেওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তেমন নেতা আওয়ামী লীগে কজন আছেন? আগেও বলেছি, আবারও বলি—সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনে হয়, শেখ হাসিনা একাই পাহাড় ঠেলছেন৷ এ অবস্থায় খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের বিকল্প আওয়ামী লীগ নিজেই, তবে তা হতে হবে শুদ্ধ আওয়ামী লীগ, হাইব্রিড নয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.