জোচ্চোরদের কেন চরম দণ্ড দেওয়া হবে না?

একের পর এক যেসব ঘটে যাচ্ছে, তাতে করে নতুন ঘটনার ছায়ায় অপেক্ষাকৃত পুরোনো অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সব ছাপিয়ে এখন সবার দৃষ্টি নারায়ণগঞ্জে। এর মধ্যেই উঠল মোদি–ঝড়। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঝাপিয়ে পড়ল, কে কার আগে অভিন্দন জানাবে এবং এর মাধ্যমে দিল্লিতে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হবে, ‘আমি তোমাদেরই লোক’। এই ডামাডোলে প্রায় অলক্ষ্যে চলে যেতে বসেছে এ দেশে ঘটে যাওয়া বড় কেলেঙ্কারিগুলোর একটি, ক্রেস্ট নিয়ে সমুদ্রচুরি। একটা আপ্তবাক্য প্রায় সবারই জানা, চকচক করলেই সোনা হয় না। গণমাধ্যমের কল্যাণে তা আবার প্রমাণিত হলো। মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননার প্রতীক এই ক্রেস্ট নিয়ে যে জোচ্চুরি হলো, তা নিছক দুর্নীতি হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। জাতি হিসেবে আমরা বেইজ্জত হয়েছি। আর যারা এ কাজ করল, তারা এটা করার সাহস পেল কোথায়। তা নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন অনেকেই। এ নিয়ে তদন্ত হয়েছে, হয়তো আরও হবে। একটি কমিটি প্রতিবেদনও দিয়েছে। কয়েকজন ‘অপরাধী’কে শনাক্ত করাও হয়েছে। অবশ্য তঁাদের বিচারের আওতায় আদৌ আনা হবে কি না, আনলেও সাজা হবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। এ দেশে অপরাধীরা যদি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পক্ষভুক্ত হয়, তবে তাদের সাত খুন মাফ, এ রকম ধারণা আমজনতার। ‘ভুল’ করে যদিও বা কেউ দণ্ড পেয়ে যান, মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে ওই অপরাধীকে মাফও করে দিতে পারেন। ইতিমধ্যে অনেক খুনি আসামিও রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেয়ে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হয়তো এমনও হতে পারে, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের কথা বিবেচনা করে’ ক্রেস্ট কেলেঙ্কারির খলনায়কদের লঘু শাস্তি কিংবা ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাল-জুয়াচুরি হয়েছে অনেক এবং তা হয়েছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলোর ইচ্ছায় কিংবা প্রশ্রয়ে। দেশটা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় ছেয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকম ‘সুযোগ-সুবিধা’ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে পণ্য করার যে কুৎসিত পরিকল্পনা দেশে চালু আছে, তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের একটা সনদ এখন খুবই মূল্যবান। কোনোমতে একটা সনদ জোগাড় করতে পারলেই চাকরিতে কোটার সুবিধা হচ্ছে বংশপরম্পরায়, প্লট পাওয়া যাচ্ছে, ভাতাও বাড়ছে দিনকে দিন। আর চাকরির মেয়াদ বাড়ছে। গরিব মানুষের কষ্টের রোজগার থেকে সংগ্রহ করা খাজনার টাকায় এই লুটপাট চলছে মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ব্যবহার করে। প্রয়োজনের সময় একজন তরুণ সর্বস্বপণ করে লড়াই করবেন দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য। এটা তো বিবেকের তাড়না থেকেই উৎসারিত হওয়ার কথা। কোনো কিছু পাওয়ার আশায় তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। একটাই লক্ষ্য ছিল, দেশকে শত্রুমুক্ত করে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এটা তো কোনো চাকরি ছিল না? যখনই সুযোগ–সুবিধা দেওয়া শুরু হলো, তখনই থেকেই শুরু হলো এর অপব্যবহার। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর যঁারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, আজ তঁাদেরই জয়জয়কার। মুক্তিযোদ্ধার সনদ লেনদেন করে অনেকেই আখের গুছিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। মুক্তিযুদ্ধকে বিক্রি করে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এঁরাই এখন নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন, এঁরাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখেন, এঁরাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাগাড়ম্বর করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া নিয়েও সমস্যা আছে। সত্যিকারের সব মুক্তিযোদ্ধার কি সনদ আছে? নেই।
সবাই তো আর একটা সনদ বা দুই বছর অতিরিক্ত চাকরি করার লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেননি। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করে তঁাদের স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়ার স্বাভাবিক দায়িত্বটুকু পালন করতে ও ব্যর্থ হয়েছে। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ নেওয়ার আবেদনপত্র দেখেছি। এটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন মনে হয় শুধু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। অথচ এটা ছিল একটা জনযুদ্ধ, যাতে অংশ নিয়েছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের প্রধান অবলম্বন ছিলেন ছাত্র-যুবারা। তাঁদের অনেকেই ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী, যাঁরা যুদ্ধ করেছেন রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যে। আমার জানামতে, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের আওতার বাইরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক সদস্য আলাদা প্রশিক্ষণ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই কোনো সনদ পাননি এবং এ জন্য তাঁদের খুব একটা আক্ষেপ আছে বলেও মনে হয় না। কিন্তু যখন অন্যদের, যঁাদের মধ্যে অনেকেই সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেকেই ভুয়া, এঁরা যখন সনদ এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে শুরু করলেন, তখনই প্রশ্ন উঠল অবিচার এবং বৈষম্যের। এখানে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই। কয়েক বছর আগে একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে মরণোত্তর সনদ দেন। এঁদের মধ্যে মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণি এবং মুজিব বাহিনীর সদস্য শেখ জামালও আছেন। এটা করে প্রধানমন্ত্রী সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা দুজন প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য।
অথচ আমার জানামতে, মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন সাত হাজার। তাহলে আর যঁারা আছেন, তাঁরা কেন সনদ পাবেন না? একটি সনদের জন্য আবেদনপত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাইবা কেন ছোটাছুটি করবেন? এটা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাঁদের খুঁজে বের করা এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া? এঁদের তালিকা সংগ্রহ করা তো তেমন কঠিন কাজ নয়৷ এঁদের চার অধিনায়কের একজন এখনো প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার সদস্য৷ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুটো ঘোরতর অন্যায় কাজ হয়েছে। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই অবহেলা এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করা হয়েছে। শেষমেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দিতে গিয়ে আমাদের বিদেশি বন্ধুদের ইমিটেশন ক্রেস্ট দিয়ে জালিয়াতি করে সারা দেশ ও জাতিকে ছোট করা হয়েছে। যারা এটা করেছে, তাদের কি বিচার হবে? আমাদের পেনাল কোডে জালিয়াতির জন্য কী ধরনের সাজা বরাদ্দ আছে জানি না। ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে পড়েছি, এককালে রাজা-রানিদের সুশাসন ছিল। বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেত। ন্যায়বিচার ছিল। বিচারে বড় অপরাধীদের শূলে চড়ানো হতো। এ সময় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতো এবং সবাই ধন্য ধন্য করত। প্রজারা মহাসুখে বসবাস করত। আমাদের পেনাল কোডে শূলে চড়ানোর বিধান নেই। এটা হয়তো মানবাধিকারকর্মীদের পছন্দ হবে না। রাজা-রানিদের আমলে তো মানবাধিকার সংগঠন ছিল না৷ আমাদের পেনাল কোডে গুরুতর অপরাধীদের জন্য ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলার বিধান আছে। সোনা-রুপা গায়েব করে দেওয়ার জন্য হয়তো এ রকম দণ্ড নেই। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে যারা একটা জাতির সম্মান খুন করতে পিছপা হয় না, তাদের কোনো চরম দণ্ড দেওয়া হবে না?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.