ট্যাক্সিক্যাব সমাচার

উপাখ্যানটি বহুশ্রুত, সত্য-মিত্যা জানি না, তবে সত্য হওয়ারই সমূহ সম্ভাবনা: বিতর্কিত ও স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন লেখক-সাংবাদিক মিনার মাহমুদ। তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর তিনি দীর্ঘদিন আমেরিকায় বাস করে সাম্প্রতিক কালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর হঠাৎ করে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তো আমেরিকায় অবস্থানকালে তিনি নিউইয়র্ক নগরে ট্যাক্সিক্যাব চালাতেন। সে সময় একদিন যাত্রী হিসেবে তাঁর ট্যাক্সিতে ওঠেন একজন সাদা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। রাস্তায় যানজটে আটকা পড়ে (নিউইয়র্ক শহরেও আজকাল বেশ যানজট হয়) ভদ্রলোক ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে গল্প করতে শুরু করে দিলেন। একপর্যায়ে চালক বাংলাদেশ থেকে আগত জানতে পেরে তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন, চালক তসলিমা নাসরিনকে চেনেন কি না। ‘চিনবা না কেন, সে তো আমার এক্স-ওয়াইফ’—মিনার মাহমুদ জবাব দিলেন। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ মিটারে প্রদর্শিত ভাড়া মিটিয়ে মাঝপথে ট্যাক্সি থেকে নেমে গিয়ে চালকের উদ্দেশে উপদেশ ছুড়ে মারলেন, ‘নেভার ড্রাইভ হোয়েন ইউ আর ড্রাংক—মাতাল অবস্থায় কখনো গাড়ি চালিয়ো না।’ স্পষ্টতই তসলিমা নাসরিনের সাবেক স্বামী ট্যাক্সিক্যাব চালান, এটা মেনে নিতে পশ্চিমা ভদ্রলোকের কষ্ট হচ্ছিল বৈকি! তা সে যাই হোক। সরকার সম্প্রতি আমাদের রাজধানী নগরে নাগরিকদের সুবিধার্থে নতুন আঙ্গিকে একটি ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস প্রবর্তন করেছে। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন বিলেতে বসবাসরত তখন ওখানকার টেলিভিশনে প্রদর্শিত জ্ঞান ও বুদ্ধিভিত্তিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘মাস্টারমাইন্ড’-এ লন্ডনের এক ট্যাক্সিক্যাব চালক চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে ট্যাক্সি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই তিনি ট্যাক্সিতে বসে সাধারণ জ্ঞানের বই পড়তেন।
আমাদের দেশে এটা কল্পনাও করা যায় না। আমাদের দেশের এক মন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন—গাড়ি চালাতে বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজন নেই; রাস্তায় গাড়ি চালানোকালে কে গরু আর কে মানুষ, এটা নির্ণয় করতে পারলেই হলো। তবে জনগণের সুবিধার্থে প্রবর্তিত এই সার্ভিস কতটা জনবান্ধব হয়েছে, তা ভাবার বিষয়; কেননা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে স্ট্যান্ড থেকে যাত্রীর অবস্থান পর্যন্ত আমার ভাড়াটাও নাকি অযৌক্তিকভাবে যাত্রীকেই দিতে হবে। ফিরে আসি নিউইয়র্কের হলুদ বর্ণের ট্যাক্সি ক্যাবের চালকদের কথায়। নিউইয়র্কের এক ট্যাক্সিচালক পূর্ব-পরিচিত ম্যানহাটনের জনৈক কোটিপতিকে তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার পর কোটিপতি তাঁকে ভাড়ার ওপরে যৎসামান্য ‘টিপস’ প্রদান করলে তিনি বলে বসেছিলেন, ‘আপনার মেয়ে কিন্তু আমাকে এর থেকে অনেক বেশি টিপস দিয়ে থাকেন। প্রত্যুত্তরে কোটিপতি বললেন, ‘হতে পারে; ওর বাপ তো কোটিপতি। আমার বাপ কোটিপতি হলে আমিও তোমাকে তদ্রূপ টিপস দিতাম।’ অবশ্য কথাবার্তায় লন্ডনের বিখ্যাত কালো ট্যাক্সিক্যাবের চালকেরাও কম যান না। গল্প আছে: একবার এক আমেরিকান পর্যটক বিলাতে বেড়াতে এসে সেখানকার কালো ট্যাক্সিতে করে লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ট্যাক্সিচালক যতই বিশাল ও সুউচ্চ অট্টালিকা দেখান না কেন, ওঁর মুখে স্রেফ এক কথা—‘আমাদের দেশে এ রকম বিল্ডিং আমরা বড়জোর সাত দিনে তৈরি করতে পারি।’ এমনকি বাকিংহাম প্রাসাদের বেলায়ও ওঁর কাছ থেকে একই রকম মন্তব্য পাওয়া গেল। ততক্ষণে ইংরেজ ট্যাক্সিচালকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম হয়েছে, কিন্তু তিনি যাত্রীকে চটাতে চাচ্ছেন না। অবশেষে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনের কাছে এসে যাত্রী ‘ওটা কী’ জিজ্ঞেস করতেই ট্যাক্সিচালক বলে উঠলেন, ‘দুঃখিত, আমি বলতে পারব না, স্যার। আজ সকালে আমি যখন এদিকে ট্যাক্সি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ওটা এখানে ছিল না।’ তা নিউইয়র্ক ও লন্ডনের ট্যাক্সিচালকদের নিয়ে খোশগল্প যখন হলো, প্যারিসের ট্যাক্সিচালকেরা বাদ যাবেন কেন?
প্যারিসের ট্যাক্সিচালকেরা যুক্তি প্রয়োগে ওস্তাদ। গল্প আছে: শার্লক হোমস-এর স্রষ্টা বিখ্যাত ইংরেজ গোয়েন্দা কাহিিন লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল একবার প্যারিসে ট্যাক্সিক্যাবে করে স্টেশন থেকে তাঁর হোটেলে পৌঁছান এবং তিনি যখন ট্যাক্সি থেকে নামতে যাচ্ছেন তখন চালক বলে উঠলেন, ‘মেখ্ছি (ধন্যবাদ), মাঁসিয়ো কোনান ডয়েল।’ ডয়েল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কে, এটা আপনি কীভাবে জানলেন? ‘প্রত্যুত্তরে ট্যাক্সিচালক যা বললেন তাতে বিখ্যাত গোয়েন্দা কাহিিন লেখকের চক্ষু চড়কগাছ।’ আজকের পত্রিকায় একটা খবর ছিল যে আপনি আজ প্যারিসে পৌঁছবেন, চালক বলে যেতে লাগলেন, ‘আপনার চেহারা দেখে আমি বুঝে নিয়েছি যে আপনি একজন ইংরেজ। তদুপরি আপনার নাম আপনার সঙ্গের লাগেজে লিখা আছে।’ আর হ্যাঁ, দুনিয়ার সর্বত্র ট্যাক্সিক্যাব চালকেরা সুযোগ পেলেই যে সোজা রাস্তার পরিবর্তে ঘুরপথে ঘুরিয়ে নিয়ে প্যাসেঞ্জারের পকেট খালি করার প্রয়াস পান, এ কথাটা সুবিদিত। যে কারণে জনৈক রসিক ব্যক্তি একদা বলেছিলেন, ইংরেজিতে ‘ট্যাক্সক্যাব’ না বলে ‘ট্যাক্সিডার্মি ক্যাব’ বলা উচিত, যেহেতু চালকেরা সুযোগ পেলেই যাত্রীদের চামড়া তুলে নেন। নিউইয়র্কের একজন ট্যাক্সিক্যাব চালক মি. রবার্টসন ও একজন িগর্জার বিশপ ফাদার ফ্লিন একই দিনে পরলোকগমন করলে সেইন্ট িপটার স্বর্গের পার্লি গেটে উভয়কে অভ্যর্থনা জানিয়ে ট্যাক্সিক্যাব চালকের জন্য বরাদ্দ করলেন একটি প্রাসাদোপম অট্টালিকা nআর বিশপের জন্য বরাদ্দ করলেন একটি মামুলি একতলা ভবন। বিশপ এতে আপত্তি জানালে সেইন্ট িপটার বললেন, ‘আমরা ইহলোকে কাজের ফলাফলের ওপর এখানে আবাসন বরাদ্দ করে থাকি। আপনি যখন িগর্জায় সারমন দিতেন তখন সেথায় লোকজন ঘুমাত, আর ট্যাক্সিচালক যখন রাস্তায় তীব্রগতিতে গাড়ি চালাত তখন আরোহীরা তো বটেই, রাস্তার লোকজনও কেবল ঈশ্বরের নাম জপ করত।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷

No comments

Powered by Blogger.