প্রশ্নপত্র ফাঁস- জয় ফাঁসুরেরা! by ফারুক ওয়াসিফ

পরীক্ষার মধ্যে অগ্নিপরীক্ষাই চরম৷ প্রাচীনকালে সাধুরা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেন৷ যিনি জাদুবলে অক্ষত থাকতেন, তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে কারও আর সন্দেহ থাকত না। কিন্তু রামায়ণের সীতা বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে দিতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে মাটিকে মা ডেকে তার মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আর বিসিএস পরীক্ষা তেমনই অগ্নিপরীক্ষাসম ঘটনা। সেই প্রথম শ্রেণিতে যে একবার পরীক্ষায় বসতে হলো, তার পর থেকে ‘যতই পড়িবে, ততই ভুগিবে’ অবস্থা। সীতার মতো আধুনিক পরীক্ষার্থীদেরও তো ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। উপর্যুপরি প্রশ্নপত্র ফাঁস তাদের মুক্তির পথ খুলে দিয়েছে। যাঁরা এই মহান কাজে নিয়োজিত, তাঁরা অবশ্যই পুরস্কারের যোগ্য কাজ করছেন।

ফাঁস শব্দটির আরেকটা মানে ফাঁসি৷ যাঁরা ফাঁসিতে মৃত্যু নিশ্চিত করেন, তাঁদের বলা হয় ফাঁসুরে৷ ফাঁসিতে রক্ত ঝরে না, অস্ত্র লাগে না। তাই ফাঁসির মাধ্যমে হত্যা বিনা রক্তপাতে যুদ্ধজয়ের মতোই মানবিক ও অহিংস পদ্ধতি। এ জন্য জেলখানায় ফাঁসুরেদের বেতন দিয়ে রাখা হয়। যাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের খেলায় শিক্ষার ফাঁসি দিচ্ছেন, তাঁদেরও ফাঁসুরে বলতে পারি। তাঁরাও বিনা রক্তপাতে শিক্ষাকে ধ্বংস করছেন এবং শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে শিক্ষার ভাইরাস তাড়াচ্ছেন। পেশা হিসেবে এঁদের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন৷

যুক্তরাজ্যের সংগীত দল পিংক ফ্লয়েডের ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দি ওয়াল’ (১৯৭৯) গানটি আশির দশকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায়৷ সত্তর দশকে ভারতের নকশাল আন্দোলনের তরুণেরা বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের জন্য বইপুস্তক, সার্টিফিকেট ইত্যাদি পোড়াত৷ পিংক ফ্লয়েডের গানটি যেন এই আন্দোলনেরই আমেরিকান প্রতিধ্বনি। গানটির একটি কথা হলো, ‘উই ডোন্ট নিড নো এডুকেশন’ অর্থাত্ আমাদের কোনো শিক্ষার প্রয়োজন নেই। এসবের মাধ্যমে ভীতিকর শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের কঠোর অনুশাসন এবং অর্থক্ষমতাকামী শিক্ষাকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন৷ এ জন্য তাঁদের এত কঠিন রাস্তা নিতে হয়েছিল, কারণ তাঁদের দেশে আমাদের মতো দক্ষ ফাঁসুরে ছিল না। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গেরিলা কৌশলের চেয়ে আর কোনো সহজ পথের কথা কেউ জানে না।

এটা চলছে এবং চলবে বলেই মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে ফাঁসের অবদান গণতান্ত্রিকও হচ্ছে। ফাঁসের ফজিলত কেবল শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, শিক্ষকদের জন্যও নাজেল হচ্ছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজশাহীতে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। মেসে মেসে এবং ফটোকপির দোকানে তা দেদারসে বিক্রিও হয়েছে। সবই ঠিকঠাক চললেও বাদ সাধছেন একদল পুরোনোপন্থী শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক৷ তাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। শুক্রবারই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল অবস্থান ধর্মঘট করে প্রতিবাদ করেছেন৷ কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী অটল মনোভাব নিয়ে বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে না, যা দেখা যাচ্ছে সেটা সাজেশন৷ এ রকম অব্যর্থ সাজেশন যাঁরা দেন, তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা না থেকে পারে না। এমন বিস্ময়কর প্রতিভাদের রক্ষা করা অবশ্যই বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব বটে!

ফাঁসুরেরা তাই বিপ্লবী দায়িত্ব পালনই করছেন। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেক ছেলেমেয়েই কারাগারের সঙ্গে তুলনা করে। শিক্ষা তাদের শ্রম, সময় ও বয়স কেড়ে নেয়। প্রকৃতিতে কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। আর কোনো প্রাণীকে স্কুল-কলেজে যেতে হয় না, পরীক্ষায় বসতে হয় না, বিদ্যার বোঝা বইতে হয় না। এ জন্যই তারা স্বাধীন৷ স্বর্গেও কোনো পরীক্ষার বালাই নেই। মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সামাজিক স্বপ্ন হলো সাম্যবাদ। সেখানেও ক্যারিয়ার তৈরির জন্য পরীক্ষা দিতে হবে না; এমনটাই জানি৷ তা ছাড়া দিবারাত্র কঠিন পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিতে জাতির যে মূল্যবান ক্যালরি খরচ হয়, কোচিং সেন্টারের সাজেশন ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কৌশলে সেটা বাঁচতে পারে। কে কত প্রশ্ন ফাঁস করতে পারে, তার প্রতিযোগিতা এ দেশে কোচিং সেন্টারের বিকাশের স্বার্থেই জরুরি৷ এতসব কারণে শিক্ষাকে ফাঁসি দেওয়ার রক্তপাতহীন এই পদ্ধতিকে স্থায়ী করা দরকার। নতুন জাতি গঠনে এর অবদান অস্বীকার করা হবে আহাম্মকি। বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারকে ফ্যাসিবাদী সরকার বলে থাকে৷ আমার মনে হয়, তারা ভুল করছে৷ এই সরকারের আমলে প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেভাবে ফাঁস হয়েছে, তাতে একে ফ্যাসিবাদী না বলে ফাঁসিবাদী বলা যেতে পারে৷

পরাধীনতা আর শিক্ষা সমার্থক৷ ইংরেজের শাসনে পরাধীনতা আর পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় একই সময়ে চালু হয়৷ দেশ স্বাধীন হলেও আজও সেই পদ্ধতিই চলছে। সুতরাং স্বাধীন দেশের স্বাধীন তারুণ্যের কাজ হলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের পথে পরাধীনতার শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া৷ আমাদের তরুণদের পড়ালেখা করে দেশের ভার নেওয়ার প্রয়োজন নেই৷ সেই দায়িত্ব গডফাদারদের আর বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলেই চলে। দায়িত্ব নেওয়া, বড় পদে চাকরি করায় অনেক ঝক্কি৷ তাঁদের এতসব ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতেই লাখ লাখ বিদেশি বাংলাদেশের বড় বড় চাকরি ও ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছেন৷ অন্যদিকে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বেকারদের দলে নাম লেখাচ্ছেন। স্নাতকদেরও ৪৭ শতাংশই বেকার৷ ওদিকে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সস্তা মজুরের অভাবে সমস্যা হচ্ছে। স্নাতক ও উচ্চশিক্ষিতদের দিয়ে এই অভাব পূরণ হওয়ার নয়৷ তা ছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষিতদের চেয়ে কম শিক্ষিত পোশাকশ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান অনেক বেশি৷ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফজিলত হলো: এতে শিক্ষার গুরুত্ব কমবে, বেকারত্ব বাড়বে৷ ফলে দামি চাকরিগুলো বিদেশিদের দিয়ে বেকারদের শ্রমবাজারে পাঠাতে পারব৷ জোগান বাড়লে দাম কমে৷ শ্রম আরও সস্তা হলে বিদেশিরা আরও শ্রম কিনতে আসবে এবং সস্তা শ্রমের আড়ত হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম অটুট থাকবে৷ ফাঁসুরেরা আমাদের এই অমিতসম্ভাবনার সামনেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এত যুক্তির পর ফাঁসুরেরা যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিভাবান সংগ্রামী, তাতে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়৷ বিশ্বে এ ধরনের ফাঁসুরেদের বিপুল কদর৷ কম্পিউটারের গোপন তথ্য যাঁরা ফাঁস করেন, তাঁদের হ্যাকার বলে৷ অনেক দেশেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁদের মোটা বেতন দিয়ে রাখে৷ যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও সিআইএর গোপন দলিল ফাঁস করে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও এডওয়ার্ড স্নোডেন বিশ্বনন্দিত হয়েছেন৷ অনেকেই এঁদের পুলিত্জার অথবা নোবেল পুরস্কার দেওয়া দরকার বলে মনে করেন৷ আমাদের ঘরে ঘরে যে এ রকম অ্যাসাঞ্জ ও স্নোডেন তৈরি হয়ে আছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ছাড়া তা কি জানতে পারতাম? প্রতিভা আগুনের মতো, চাপা দিয়ে রাখা যায় না৷ আমাদের মিনি অ্যাসাঞ্জরা শিক্ষা বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা আর শিক্ষা দপ্তরের জারিজুরি যেভাবে ফাঁস করেছেন, তা অতুলনীয়৷ সাংবাদিকেরা আজকাল গোপন তথ্য ও দলিল ফাঁস করতে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে ফাঁসুরেরা নিজেদের পেশায় দুর্ধর্ষ রকম সফল৷ ইদানীং তো বিভিন্ন নেতানেত্রীর ফোনালাপ থেকে শুরু করে পেশাদার খুনিদের সলাপরামর্শ ফাঁস হচ্ছে৷ প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে ক্ষমতাবানদের গোপন কথা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাঁড়ির খবর সব ফাঁস হচ্ছে৷ জাতি হিসেবে আমরা যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফাঁসবাজির প্রতিভা দেখাচ্ছি; তা নিশ্চয়ই আশার কথা৷ শুনেছি ফাঁসির দাবিতে বড় আন্দোলন করা এক নেতার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস করা দিয়ে৷ আজ যাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বীরত্ব দেখাচ্ছেন, তাঁরা আসলে দেশবাসীকে আরও বড় আকারে আলোড়িত করার প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছেন৷ মর্নিং শোজ দ্য ডে৷

বাঙালি প্রতিভা ও সম্পদের কদর করতে জানে না৷ উলুখাগড়ার মহারাজকে একবার তাঁর বন্ধু জরির নাগরা জুতো উপহার দিলেন৷ বেচারা হঠাত্ মহারাজা; তাই বুঝতে পারলেন না এই জরিবাঁধানো নৌকার মতো বাঁকা জিনিসটা কোথায় পরতে হয়৷ দেখতে তো রাজমুকুটে যে জরি-মুক্তাখচিত জিনিসটা থাকে, তার মতোই দেখায়৷ অনেক চিন্তাভাবনার পর এক প্রভাতে নাগড়াই জুতা দুটির একটিকে পাগড়ির মাথার সঙ্গে লাগিয়ে তিনি দরবারে দেখা দিলেন৷ ফাঁসুরেরা আমাদের সম্পদ, প্রতিভার শিরোমণি৷ সরকার যে তাঁদের দমন না করে বরং মাথায় তুলে দেশবাসীকে ‘শিক্ষা’ দিচ্ছে; এ জন্য তাঁদের অভিনন্দন জানাতেই হয়৷ জয় ফাঁসুরে!

No comments

Powered by Blogger.