নারায়ণগঞ্জে সবই আওয়ামী লীগ! by সোহরাব হাসান

সারা দেশের মানুষ যখন মে দিবসের আনন্দ ও ছুটি ভাগ করে নিচ্ছে, তখন নারায়ণগঞ্জবাসীর মনে আনন্দ নেই। ছুটি কাটানোর অবকাশ নেই। শ্রমিক সমাবেশে উদ্দীপ্ত স্লোগান নেই। মে দিবসে তাঁরা চোখের জলে বিদায় জানালেন ছয়জন প্রিয় মানুষকে। আগের দিন শীতলক্ষ্যায় যাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁরা কেমন মানুষ ছিলেন সেই বিচার এখানে করছি না। তাঁরা ভালো মানুষ হতে পারেন, আবার তাঁদের মধ্যে কেউ খারাপ মানুষও থাকতে পারেন। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কেন থাকবে না? কোনো অপরাধ করলে তার বিচার হতে পারত। বিচারের আগেই এ রকম মৃত্যু কিসের ইঙ্গিত দেয়?
গত রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে গুম করা হয়। কোথায় কারা ও কেন গুম করেছে, জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি তাঁরা প্রথমে মামলাটিও নিতে চাননি। তাঁরা নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন, অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টার ফল দেখলাম নদীতে ছয়টি লাশ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে। কেউ জীবিত ফিরে এলেন না। বুধবার শীতালক্ষ্যায় ছয়টি লাশ ভেসে উঠল। পরদিন মে দিবসে আরও একটি। এ যেন কোলাহলমুখর কোনো জনপদ নয়। নীরব-নিথর মৃত্যুপুরী। লাশের পাশে স্বজনদের আহাজারি ও বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু ঘাতকের সন্ধান মেলে না। তারা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান?

নারায়ণগঞ্জে কারা লাশ হচ্ছেন, সেটি জানা গেলেও কারা লাশ করছেন, সেটি কখনো জানা যাবে কি না—আমরা জানি না। জানে না নারায়ণগঞ্জের মানুষও। এ পর্যন্ত এই বন্দরনগরে এ ধরনের খুনের বিচারের নজির নেই। আসামি ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে যায়। খুনির পক্ষে নানা তদবির চলে। দোষ স্বীকার করার পরও অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে জামিন পেয়ে যায়। তাই প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে, সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—আদৌ সাত হত্যার বিচার হবে কি না? ঘাতকেরা শাস্তি পাবে কি না?

২.
দেশের অন্যান্য স্থান থেকে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির চালচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো মৌলবাদী দলের তেমন তত্পরতা নেই। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বহুদিন ধরেই নিষ্ক্রিয়। এমনকি অনেক সময় তাদের রুটিন কর্মসূচিও পালিত হয় না। তারা করতে সাহস পায় না। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বা প্রধান বিরোধী দলের পক্ষে এখানে সাতটি মানুষকে 'নাই' করে দেওয়ার আশঙ্কা একেবারেই শূন্য। এমনকি  সাত খুনের ঘটনার পর সে রকম অভিযোগ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও কেউ করেননি।

প্রকৃত প্রস্তাবে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের বাইরে কিছুই নেই। এখানকার প্রশাসন আওয়ামী লীগের অনুগত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের কথায় উঠবস করে। অধিকাংশ ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের নেতাদের দিনে-রাতে সালাম দেন। এখানে পাঁচটি নির্বাচনী এলাকার তিনটিতে বিজয়ী আওয়ামী লীগ এবং দুটিতে এরশাদের জাতীয় পার্টি। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যানেরা সব আওয়ামী লীগেরই।

তাহলে নারায়ণগঞ্জে এসব গুম-খুন কারা করছে? আওয়ামী লীগের ভেতরেরই কোনো শক্তি বা অপশক্তি? নিহত সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা। আবার তাঁর হত্যার দায়ে যাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে, সেই নুর হোসেনও একজন কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগের নেতা। আবার এই কাউন্সিলরই সাংসদ শামীম ওসমানের শিষ্য। দুই শিষ্যের মধ্যে কে কতটা ভালো, কতটা খারাপ, সেটি তাঁদের রাজনৈতিক গুরুরই ভালো জানার কথা। শামীম ওসমান নজরুল ইসলামকে আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও অত্যন্ত আদরের মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। তবে অভিযুক্ত নুর হোসেন আদরের কি না, সে কথা তিনি বলেননি।

শোনা যায়, নারায়ণগঞ্জে মাঝেমধ্যে গায়েবি আওয়াজ আসে আগামী অমুক তারিখ জঙ্গি হামলা হবে। অমুক তারিখ অমুকের ওপর হামলা হবে। বিরোধী দলের নেতা নারায়ণগঞ্জে এলে ২০০ লাশ পড়বে। কিন্তু বিরোধী দলের কোনো নেতা বা পাতি নেতা নারায়ণগঞ্জে না এলেও লাশ পড়া বন্ধ হয় না। নদীতে মানুষের লাশ ভেসে ওঠা থামে না। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, নারায়ণগঞ্জে যাঁরা লাশ হন, তাঁরা যেমন আওয়ামী লীগার, তেমনি যাঁদের বিরুদ্ধে মানুষ খুন ও গুম করার অভিযোগ রয়েছে, তাঁরাও আওয়ামী লীগার। এখানে সবই আওয়ামী লীগ। খাঁটি দেশপ্রেমিক।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.