চৌদ্দগ্রামে মন্ত্রীর পিএ- সাংবাদিক মারলে কি হয়? by নিয়াজ মাহমুদ

এক মিনিট কেন্দ্রে থাকলেই তোদের লাশ পড়বে, সাংবাদিক মারলে কি হয়? এই মুহূর্তে কুমিল্লা ছাড়বি। তা না হলে  তোদের সবগুলোকে পুলিশে দেবো। এভাবে ঢাকা থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে উপজেলা নির্বাচন কাভার করতে আসা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনের সাংবাদিকদের হুমকি দেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের পিএ মোশাররফ হোসেন। পাশাপাশি সকাল থেকেই এ উপজেলার  ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টি কেন্দ্র দখলে নেয় মন্ত্রীর লোকজন।  মন্ত্রীর নিজ কেন্দ্র শ্রীপুরের নাটচরে ১৯ দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সোহেলকে লাথি দিয়ে বের করে দেয় মন্ত্রীর লোকজন।  এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনাকে ভোট ডাকাতির উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ১৯ দলীয় জোটের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। আর ১৯ দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী উপজেলা নির্বাচন স্থগিত চেয়ে আজ অর্ধদিবস হরতাল  দিয়েছেন চৌদ্দগ্রামে।

>>রেলমন্ত্রীর পিএ মোশাররফ হোসেন ছবিটি ফেসবুক থেকে নেয়া
সকাল ১০টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার অশ্বদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পৌঁছলে দেখা যায়, রেলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মোশাররফ হোসেন শতাধিক ক্যাডার নিয়ে কেন্দ্রের সামনে মহড়া দিচ্ছেন। এ সময় তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। সাংবাদিকরা কেন্দ্র পরিদর্শন করতে চাইলে তিনি ক্ষেপে যান। পাল্টা সাংবাদিকদের পরিচয় জানতে চান। একপর্যায়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে নিজেকে মন্ত্রীর পিএ পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের আটক করে পুলিশে দেয়ার হুমকি দেন। এ সময় মোশাররফের ক্যাডার বাহিনী সাংবাদিকদের ঘিরে ধরে গালাগাল করে। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের টানাহেঁচড়া করতে থাকে। মোশাররফ সাংবাদিকদের মারার জন্য লাঠি আনতে নির্দেশ দেন তার ক্যাডার বাহিনীকে। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে জোরপূর্বক ধাক্কা দিয়ে সাংবাদিকদের গাড়িতে তুলে দেন তিনি। এ প্রতিবেদকের মুঠোফোনটিও জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেন মোশাররফ। মোবাইল ফোনটি ফেরত চাইলে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
ফোনটি কয়েক ঘণ্টা নিজের কাছে রেখে বিকালে তা ফেরত দেন স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে। মন্ত্রীর পিএ’র উপস্থিতিতেই কেন্দ্রের ভেতরে দেদারসে জাল ভোট চলছিল। আর ভোটার লাইনে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের রেশির ভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে ছিল। সেখানে প্রিজাইডিং অফিসার হাফেজ আহমেদ ও সরকার সমর্থক আনারস প্রতীকের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন চেয়ারম্যান প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। এই কেন্দ্রের ৩৩৭০ ভোটের মধ্যে সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৪০০ ভোট কাস্ট হয়। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের  ওপর চড়াও হয়ে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীরা। তাদের হামলায় উপজেলার বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আহত হন এনটিভির সিনিয়র রিপোর্টার শফিক শাহীন, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর-এর স্টাফ রিপোর্টার মাকসুদ-উন-নবী, জেলা করেসপন্ডেন্ট আশিকুন নবী সোহেল এবং একই উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের কুনকুট ভোট কেন্দ্রে যায়যায়দিনের স্টাফ রিপোর্টার কামরুজ্জামান বাবলুর ওপর হামলা চালান ইউপি চেয়ারম্যান। হামলার পর তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হয়। সরজমিনে উপজেলার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, শনিবার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর পরপরই আওয়ামী সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুস সোবহান ভুইয়া হাসানের সমর্থিত কর্মীরা উপজেলার  জগন্নাথ, আলকোরা ও গুণবতী ইউনিয়নের সব ক‘টি কেন্দ্রসহ মোট ৭৩টি ভোট কেন্দ্র তাদের দখলে নিয়ে নেয়। এছাড়া কাশিনগর ইউনিয়নের কাশিনগর বাজার মাদরাসা কেন্দ্র, কাতালিয়া কেন্দ্র এবং শ্রীপুর ইউনিয়নের নালঘর, পদুয়া ও নারচর পুরো দখলে নিয়ে এজেন্টদের জোরপূর্বক কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে সিল মারে আনারস প্রতীকে। উপজেলার তারাসাইল কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার গোলাম মহিউদ্দিন আজিমকে জোরপূর্বক  বের করে দিয়ে তার কাছে থাকা ব্যালট পেপার, সিল ও ২১টি ভোট দেয়ার মুড়ি ছিনতাই এবং হিঙ্গুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুর রহমান। আওয়ামী লীগের নেতা হাসেম বিল্লাহর নেতৃত্বে মর্কোটা ভোট কেন্দ্রে অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে ১২ জন আহত ও ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়। রেলমন্ত্রীর কেন্দ্র শ্রীপুরের নাটচরে  সকাল   ৯টায় ১৯ দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সোহেলকে লাথি দিয়ে বের করে দেয় মন্ত্রীর লোকজন। ১৯ দলের চেয়ারম্যান প্রার্থী কামরুল হুদা  ও পোলিং এজেন্ট সোহেল মানবজমিনকে এ অভিযোগ করেন। এসব চিত্রের পাশাপাশি কাশিনগর ইউনিয়নের কাশিনগর ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাহারের নেতৃত্বে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা জাল ভোটের উৎসব পালন করে। তবে এসব চিত্র সকল কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা দেখলে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। অনেক জায়গায় পুলিশকে আওয়ামী লীগের কর্মীদের জাল ভোট দিতে সহায়তা করতেও দেখা গেছে। এসব কেন্দ্রে স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের লাইনে দাঁড়িয়ে ভুয়া নাম্বার স্লিপ দিয়ে ভোট দিয়েছে।
এদিকে, ১৯ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক দলের নেতা জাতীয় পার্টি (একাংশের) চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদ উপজেলা বিএনপি অফিসে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। পাশাপাশি তিনি আজ রোববার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় অর্ধ দিবস হরতাল আহ্বান করেন।  তিনি বলেন, এটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। তিনি বলেন, ভোটের আগের রাতে মন্ত্রী পতাকা উড়িয়ে প্রটোকল নিয়ে ঘুরে ভোট ডাকাতির নির্দেশ দেন। কাজী জাফর বলেন,  আমরা আগেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এই চিত্র তুলে ধরেছি। কিন্তু আমাদের বক্তব্য আমলে নেয়নি  কমিশন। নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে ভোট ডাকাতির উৎসব হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা ১৯ দলের চেয়ারম্যান প্রার্থী কামরুল হুদা বলেন, শনিবার রাত থেকেই বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ভোট ডাকাতির মহোৎসব  হয়েছে- যা কুমিল্লাবাসী এই প্রথম দেখলো। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. নয়ন বাঙ্গালী, জামায়াত নেতা আব্দুস সাত্তার, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সাহাবুদ্দিন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রাহেনা আক্তারসহ উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ।

No comments

Powered by Blogger.