এই তরুণদের আমরা কী কাজে লাগাচ্ছি?

এই তরুণদের আমরা কী কাজে লাগাচ্ছি?
মার্চের প্রথম সপ্তাহে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় অর্থনীতি বিষয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘উচ্চশিক্ষিতদের প্রায় অর্ধেকই বেকার’, ‘স্বল্পশিক্ষিতদের হাতেই সচল অর্থনীতি’ এবং ‘চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরাই বেশি বেকার’। ব্যতিক্রমী ও অনুসন্ধানী এই প্রতিবেদনগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকদের ধন্যবাদ জানাই। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যখন মধ্য আয়ের এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভোর, তখন এই প্রতিবেদন চোখে আঙুল দিয়ে কঠিন সত্যই তুলে ধরেছে। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রথম আলো আরও জানায়,
‘বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে, ৬৫ শতাংশ। এর বাইরে ভারতে এ হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্যমতে, বেকারত্বের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকারের সংখ্যা ছয় কোটিতে দাঁড়াবে। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে—এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১২ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ। তাঁদের মধ্যে ৯২ হাজার ৭৪৭ জন স্নাতক পাস, এক লাখ ২৮ হাজার ৪৮১ জন স্নাতক সম্মান এবং ২১ হাজার ৩৮০ জন কারিগরি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া এক লাখ ১৯ হাজার ৮৯৪ জন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, দুই হাজার ৩৮৫ জন স্নাতকোত্তর (কারিগরি) এবং এক হাজার ৭৬৩ জন এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অন্যদিকে বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা বা সনদ অর্জন করেন দুই হাজার ৩৩৫ জন। পরিসংখ্যান বলছে, বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ মধ্যে নারী চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের অবস্থা আরও খারাপ। তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩১ শতাংশ। এর পরেই আছেন উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ব্যক্তিরা। তাঁদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর বেকারদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছেন স্নাতকোত্তররা, ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষা নেবেন কি? একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সেই দেশের প্রতিটি কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থান। যত দিন আমরা সেই অবস্থায় যেতে না পারব, তত দিন নিজেদের মধ্য আয়ের দেশ দাবি করা বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। জনসংখ্যার ভারে প্রায় ন্যুব্জ এই দেশটিকে আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি ওই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারব না, যাতে প্রত্যেক বেকার যুবককে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা দেওয়া যাবে। অতএব, কর্মসংস্থানের প্রতিই নজর দিতে হবে এবং প্রতিটি নাগরিককে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশত্তিতে পরিণত করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে আমাদের যে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত জনশক্তি আছে, তাঁদের নিয়েও চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যতে এসব দেশ দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকই নিতে চাইবে। এই যে দেশের শিক্ষিত তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁদের মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে পারছেন না, সেটি কেবল ব্যক্তি বা পারিবারিক ক্ষতি নয়; আমাদের জাতীয় ক্ষতি। শিক্ষিত ও মেধাবী জনশক্তির প্রতি রাষ্ট্রের এই উপেক্ষা মেনে নেওয়া যায় না। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ১৫ বছর থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা সাত কোটি ৬০ লাখ ৩৮ হাজার ৭৪৫ জন। অর্থাৎ তাঁরা সবাই কর্মক্ষম। কিন্তু তাঁদের কাজে লাগাতে পারছি না। এমনকি কাজে লাগানোর জন্য যে সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন, সেই উপলব্ধি রাষ্ট্রের পরিচালকদের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জনসভায় লোক আনতে তরুণদের ব্যবহার করতে যতটা সক্রিয়, তাঁদের কর্মসংস্থান বাড়াতে ততটাই নিষ্ক্রিয়। প্রতিবছর কর্মবাজারে যে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি আসছে, তাঁদের কাজের সংস্থান করতে হলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতের প্রসার ঘটাতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
অর্থনীতির চাকা যাতে সচল ও প্রবহমান থাকে, তার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের অসুস্থ রাজনীতি বরাবরই অর্থনীতিকে অসুস্থ করে দিতে তৎপর থাকে। আমাদের সরকার ও বিরোধী দল কোনো বিষয়েই একমত হতে পারে না। এ মুহূর্তে দেশে হরতাল-অবরোধ নেই সত্য, কিন্তু কত দিন এই স্বস্তি থাকবে, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নানা প্রতিকূলতা ও বাধা সত্ত্বেও দেশের তরুণেরা নিজেদের চেষ্টায় কিছু করতে চান। তাঁরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চান। কিন্তু রাষ্ট্রের অভিভাবকদের কাছ থেকে তেমন সহায়তা পান না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প থেকে শুরু করে বেসিক ব্যাংক—সব উদ্যোগেই অশুভ শক্তির অশুভ ছায়া দেখা গেছে। আমাদের ভালো ভালো উদ্যোগগুলো দলীয়করণ, আত্মীয়করণের কারণে এবং অযোগ্যদের হাতে পড়ে বিনষ্ট হয়ে যায়। যাঁরা দেশের ও সমাজের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারতেন, সেই মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত জনশক্তিকেই আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। ফলে বহু তরুণ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আমরা প্রতিবছর সেশনজট বাড়িয়ে পরীক্ষা পিছিয়ে শিক্ষিত তরুণদের মেধাও অপচয় করছি। কিন্তু দেশের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি না। ভাবছি ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার কথা। সরকার কর্মসংস্থানভিত্তিক শিক্ষার কথা বললেও কর্মবিমুখ শিক্ষাকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশের তরুণ বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। ১৯৮৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে গড়ে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের তরুণ বেকারদের হার ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। ১৯৮৬ সালে এ হার ছিল সবচেয়ে কম, ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০০০ সালে সবচেয়ে বেশি, ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। গত ১০ বছরে বেকারের হার আরও বেড়েছে। কিন্তু এসব নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
২. গত শনিবার তৃতীয় দফায় ৮১টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হলো। আগের দুই দফার সঙ্গে তুলনা করলে এবার সংঘাত, সংঘর্ষ, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে অনেক বেশি। তিনজন মারা গেছে। এটাই কি আমাদের ভবিতব্য ছিল? এই নির্বাচনই কি আমরা চেয়েছিলাম? নির্বাচন নিয়ে এই যে সংঘাত-সংঘর্ষ ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানো হলো, তাতে কার লাভ হলো? বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায়, এবার মারামারিটা একতরফা হয়নি। বিবদমান দুই পক্ষই মোটামুটি প্রস্তুত ছিল। ফেনীর দাগনভূঞার একটি ভোটকেন্দ্রের চিত্র তুলে ধরেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি। তিনি জানিয়েছেন, ‘ভোর চারটায় ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে আওয়ামী লীগ, আর ভোর পাঁচটায় বিএনপির কর্মীরা সেই বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে যান।’ আমরা ছবিতে দেখতে পাচ্ছি, ব্যালটবাক্স পাহারা দিচ্ছেন দুজন নিরাপত্তাকর্মী। তার আগেই অনেকগুলো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা এবং সেই বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যান বিএনপির কর্মীরা। গত দুই দফার নির্বাচনী ফলাফলে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সম্ভবত উজ্জীবিত হয়ে থাকবেন। কিংবা হতে পারে ভবিষ্যতে বড় কোনো সংঘাতের প্রাথমিক মহড়া ছিল এটি। আরেকটি খবরে দেখা যায়, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার সিদালয় গোলাবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালান। এই যে এ পক্ষে ও পক্ষে থেকে একে অপরের ওপর হামলা চালালেন, তাঁরা সবাই কম বয়সী তরুণ। এই তরুণদের আমরা কী কাজে ব্যবহার করছি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব একবার ভেবে দেখেছেন?
এর এক দিন আগেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপিত হলো। ৩৫ বছর আগে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, তার সৌরভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। তিনি ১৫ লাখ ছেলেমেয়েকে বইপড়া আন্দোলনে যুক্ত করেছেন। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে শিশু-তরুণদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব পালন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এটি ছিল তাদের ১৫তম উৎসব। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানানো হয়। এই মুহূর্তে সারা দেশে প্রথম আলোর উদ্যোগে যে ভাষা প্রতিযোগ চলছে, তাতেও হাজার হাজার ছেলেমেয়ে অংশ নিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করছে। মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে শিখছে। আরও অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সাধ্যমতো তরুণদের নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু রাজনীতি চলছে উল্টো পথে। কোনো রাজনৈতিক দলকে এ ধরনের আলোকিত কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। তারা তরুণদের পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ না করে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার তালিম দেয়। কয়েক দিন আগে এক মন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে ছাত্রলীগই নাকি যথেষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলো কেন তরুণদের এই সর্বনাশা পথে ঠেলে দিচ্ছে? তরুণেরা আর কত ক্ষমতান্ধ এই রাজনীতির হাতিয়ার হবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.