বিশ্বায়নের কাল- ভদ্র পুলিশের কেলেঙ্কারি by কামাল আহমেদ

পর্যটক আকর্ষণের এক বিস্ময়কর ক্ষমতা রয়েছে ব্রিটেনের। পর্যটকেরা আসেন নানা কারণে। রাজপরিবারের প্রতি আকর্ষণ, সাহিত্য-শিল্পকলার টান, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলো প্রত্যক্ষ করার আগ্রহ, কেনাকাটা ইত্যাদি। ‘ভিজিট ব্রিটেন’ নামের এক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত বছর প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ বিদেশি পর্যটক ব্রিটিশ অর্থনীতিতে দুই হাজার ১০০ কোটি পাউন্ড জোগান দিয়েছেন। প্রতিদিন এই যে হাজার হাজার পর্যটক দেশটি দেখতে আসেন, তাঁদের অনেকেরই বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। ব্রিটিশ পুলিশ বলতে লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ, যা সংক্ষেপে ‘মেট’ নামে পরিচিত। পর্যটকেরা ব্রিটেনের যেসব স্মারক কিনে থাকেন, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় পণ্য হচ্ছে মেট পুলিশের হেলমেটের নমুনা বা রেপ্লিকা। ব্রিটিশ পুলিশের প্রতি এই আগ্রহের কারণ হচ্ছে তাদের সুনাম। বিশ্বের সবচেয়ে মার্জিত বা ভদ্র ও বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য আদর্শ পুলিশের উদাহরণ হলো ব্রিটিশ পুলিশ। তাদের নিরস্ত্র টহলদারি ও দায়িত্ব পালন অনেকের কাছেই বিস্ময়ের বিষয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন, সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট। কিন্তু সাধারণভাবে তারা সব সময়ই নিরস্ত্র অবস্থায় দায়িত্ব পালন করে থাকে। ব্রিটিশ পুলিশের মূল শক্তি তাদের প্রতি জনগণের আস্থা, যেটির ভিত্তি হচ্ছে তাদের কার্যক্রমের মূলনীতি: জনসম্মতির ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ইংরেজিতে ‘পোলিসিং বাই কনসেন্ট’। কিন্তু গত এক সপ্তাহে এই মেট পুলিশের যেসব কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা অকল্পনীয়।

মেট পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পেছনে যে ঘটনাটি বারবার ফিরে আসছে, তা হলো ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে লন্ডনে সংঘটিত একটি বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ড। একটি বর্ণবাদী চক্রের হামলায় নিহত কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ স্টিফেন লরেন্সের হত্যাকাণ্ডটিই সম্ভবত ব্রিটেনে বর্ণগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। ওই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত করতে না পারা এবং দোষী ব্যক্তিদের প্রথম দফায় বিচার করতে না পারার কারণে সৃষ্ট বিতর্কের বিষয়ে প্রথম তদন্ত হয় লর্ড ম্যাকফারসনের নেতৃত্বে, যাতে তিনি মেট পুলিশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ণবাদী বলে অভিহিত করেন। এর পর থেকে গত প্রায় দুই দশকে মেট পুলিশে নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চালানো হলেও সম্প্রতি আবার সেই পুরোনো বিতর্ক সামনে চলে এসেছে। তবে তা এসেছে আরও গুরুতর রূপে। এটি এতটাই গুরুতর যে মেট পুলিশের প্রধান স্যার বার্নাড হোগান হাও একে পুলিশের জন্য ‘ধ্বংসাত্মক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
লর্ড ম্যাকফারসন রিপোর্ট এবং নানা ধরনের সংস্কারের পরও পুলিশের তরফে স্টিফেন লরেন্সের মা ও পরিবারকে হয়রানির উপায় খুঁজতে নানা ধরনের কৌশল অনুসরণের অভিযোগ ওঠে। তাঁদের পরিবারের কেউ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, অথবা কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা খুঁজে দেখতে নজরদারির জন্য নিয়োগ করা হয় ছদ্মবেশী গোয়েন্দা। স্টিফেনের ছোট ভাইকে একাধিকবার রাস্তায় অযথা তল্লাশি করার ঘটনা ঘটে। স্টিফেনের মা-বাবার দাম্পত্য জীবনেও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। এই পটভূমিতে স্টিফেনের মা ডরিন লরেন্স তাঁর সন্তানের হত্যাকাণ্ড, এর তদন্ত এবং এই সবকিছুতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেরেসা মে পুলিশের গোপন নজরদারিব্যবস্থার বিষয়ে একটি তদন্তের ব্যবস্থা করেন।
৬ মার্চ মার্ক এলিসন কিউসির নেতৃত্বে পরিচালিত তদন্তের প্রতিবেদনে পুলিশ বাহিনীতে অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও বর্ণবাদী বৈষম্যের নীতি অনুসৃত হওয়ার বিভিন্ন আলামত তুলে ধরা হয়। মার্ক এলিসনের তদন্তে নতুন করে অভিযোগ উঠেছে যে স্টিফেন লরেন্সের হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী দলের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার গোপন সম্পর্ক ছিল হত্যাকারী চক্রের একজনের বাবার সঙ্গে, যিনি নিজেও অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত। হত্যাকারী চক্রের সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তার এই গোপন যোগসূত্রের কথা ম্যাকফারসন তদন্তের সময় গোপন রাখা হয়েছিল। এখন আরও অভিযোগ উঠেছে যে ওই একই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ড্যানিয়েল মর্গান নামের একজন বেসরকারি গোয়েন্দার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে জড়িত ছিলেন, যার কোনো সুরাহা হয়নি। ১৯৮৭ সালে নিহত ড্যানিয়েল মর্গান ওই অপরাধী চক্রটির বিষয়েই অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন, যাদের সঙ্গে একই তদন্তকারী পুলিশকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে।
মেট পুলিশে দুর্নীতি বা অনৈতিক কাজের অভিযোগ যদি শুধু এই একজনের বিরুদ্ধে উঠত, তাহলে হয়তো তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করার সুযোগ থাকত। কিন্তু একের পর এক এ ধরনের অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। পরিবেশবাদী, পশুপ্রেমী, উগ্র বামপন্থী অথবা নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলোর কাজকর্ম ও গতিবিধির ওপর নজরদারির জন্য মেট পুলিশ যেসব ছদ্মবেশী চর নিয়োগ করেছিল, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ওই সব সংগঠনের নারী কর্মীদের সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। আসল পরিচয় গোপন করে প্রণয় এবং এ ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ার কারণে এ রকম একটি গোষ্ঠীর নৈরাজ্যমূলক কিছু কাজের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা এক মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। এসব গোষ্ঠীর বিক্ষোভ, সমাবেশ বা অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম মোকাবিলায় পুলিশের যে স্পেশাল ডেমোনেসট্রেশন স্কোয়াড (এসডিএস) রয়েছে, তার বিরুদ্ধে ডজন খানেক নারী ক্ষতিপূরণের মামলা করেছেন। গার্ডিয়ান ও চ্যানেল ফোরের কাছে এসব ভুক্তভোগী নারীর একজন তাঁর অনুভূতি বর্ণনা করে বলেছেন যে তাঁর মনে হয়, তিনি যেন রাষ্ট্র দ্বারা ধর্ষিত। একজন ছদ্মবেশী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে ওই পশু অধিকার আন্দোলনের নারী কর্মীটির সম্পর্কের পরিণতিতে সন্তানেরও জন্ম হয়।
মেট পুলিশের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক কালে আরও যেসব গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে পুলিশকে গালি দেওয়ার অভিযোগ সাজিয়ে যোগসাজশে বিতর্কের জন্ম দেওয়া। ওই বিতর্কের কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁকে মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়েছিল। পুলিশের কাজকর্মে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ এখনো প্রকট। সর্বসাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায় যে পুলিশ সন্দেহবশত কোনো পথচারীকে থামিয়ে তার দেহ তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের যে কৌশলটি প্রয়োগ করে, তাতেও বর্ণবাদী বৈষম্য প্রকট। প্রতি একজন শ্বেতাঙ্গের বিপরীতে ছয়জন কৃষ্ণাঙ্গ বা অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি এই তল্লাশির সম্মুখীন হয়।
জনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজেও ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের তেমন কোনো নজির নেই। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে তারা যথেষ্ট কৌশলী এবং সে ক্ষেত্রে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উগ্র বামপন্থী ও নৈরাজ্যবাদীদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছরই পাশ্চাত্যের শহরগুলোতে মে দিবসের বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে। লন্ডনও তার ব্যতিক্রম নয়। আর এর সঙ্গে ব্যবসাবান্ধব টোরি পার্টির কৃচ্ছ্রসাধনের নীতিও ট্রেড ইউনিয়ন ও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে ২০১১ সালে লন্ডনে ছাত্রদের এবং পরবর্তী সময়ে লন্ডনের বাইরে পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভে। আর সেই পটভূমিতেই সরকার জলকামান আমদানির
কথা বিবেচনার কথা জানিয়েছে, যা এর আগে ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডে কখনোই হয়নি।
দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অধিকারী রাষ্ট্র ব্রিটেনের রাজনৈতিক কাঠামোয় পুলিশের জবাবদিহির ব্যবস্থার অভাব নেই। পার্লামেন্টারি জবাবদিহির ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনি আছে পুলিশের ওপর পুলিশি ব্যবস্থা। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ অথবা কোনো ধরনের সন্দেহ তৈরি হলেই তা তদন্তের জন্য এই আলাদা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইনডিপেনডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশন (আইপিসিসি)। কিন্তু এত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফাঁক গলেও যেসব অপকর্ম ঘটেছে, তাতে মেট পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় চিড় ধরতে শুরু করেছে। নাগরিকদের সেই আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই তাই রাজনীতিকেরা যেমন দ্রুততার সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছেন, তেমনি পুলিশকর্তারাও সংস্কারের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে ভদ্র ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীতেই যখন চোখের আড়ালে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ ও অনৈতিক আচরণের মতো অপকর্ম বছরের পর বছর ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব, তখন কুশাসন ও অপশাসনের বৃত্তে আটকে থাকা দেশগুলোয় পুলিশের জবাবদিহির গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ ব্যবস্থার কথা আর কতকাল উপেক্ষিত থাকা উচিত?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

No comments

Powered by Blogger.