এক দেশে দুই নীতি যখন আবশ্যক

প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য না পেলে
ভোটাররা চূড়ান্তভাবে ক্ষমতাহীন হবে
গত অক্টোবরের কথা। ব্রিটেনে ভারতীয় ব্যঞ্জন বা কারি রান্নায় সেরা রেস্তোরাঁগুলোর পুরস্কার বিতরণে রন্ধনশিল্পের সাময়িকী কারি লাইফ-এর এক জমজমাট অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি ব্রিটেনের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এরিক পিকলস। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন বিবিসি টেলিভিশনের সদ্য অবসর নেওয়া উপস্থাপিকা শন লয়েডস। পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার পর অতিথির সঙ্গে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়ানো সেসব ছবি পরে রেস্তোরাঁর দেয়ালে শোভা পাবে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন এরিক পিকলসের নির্বাচনী এলাকা, ব্রেন্টউড অ্যান্ড ওংগারের রেস্তোরাঁ মালিক।
শন ওই রেস্তোরাঁর মালিকের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানানোর সময় মন্ত্রীকে অনেকটা রসিকতা করে বললেন যে এঁর রেস্তোরাঁয় এবার নিশ্চয়ই খাওয়ার পর তোমাকে আর দাম দিতে হবে না! এরিক পিকলস খুবই বিব্রত হয়ে বললেন, ‘তোমার এটা বলা উচিত হয়নি। এ ধরনের আতিথেয়তা গ্রহণ করলে আমাকে তার ঘোষণা দিতে হবে।’ (ইউ শুড নট হ্যাভ সেইড দ্যাট, এনি সাচ ফেভারস নিডস টু বি ডিক্লেয়ার্ড) শন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বেফাঁস মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধিদের যে শুধু তাঁদের আয়-রোজগারের বিস্তারিতসহ সহায়-সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করতে হয় তা-ই নয়, অন্য কোথাও তাঁদের কী ধরনের স্বার্থ আছে, তা-ও জনসমক্ষে প্রকাশের একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবশ্য সবাই যে এতটা নৈতিকতার ধার ধারেন, তা নয়। আর সে কারণেই ব্রিটেনসহ বিশ্বের বহু দেশেই আইন করে এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাঁচ বছর পর পর শুধু নির্বাচনের সময় নয়, বছরজুড়েই এমপিদের তাঁদের সব ধরনের উপহার, উপঢৌকন, আতিথ্য গ্রহণ এবং বেতন-ভাতার বাইরে সব ধরনের আয় প্রকাশ করতে হয়। পার্লামেন্টে তাঁদের জন্য রাখা আছে আলাদা একটি রেজিস্ট্রার, যাতে এগুলোর ঘোষণা দিতে হয়। তা না হলে, ধরা পড়লে ভোটারদের আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে নিস্তার নেই। ক্যাশ ফর কোশ্চেন কেলেঙ্কারির জন্য টোরি পার্টির সাবেক এক মন্ত্রী নিল হ্যামিলটনের নজির এখানে স্মরণীয়। লেবার পার্টিতে টনি ব্লেয়ারের ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী লর্ড ম্যান্ডেলসনের দৃষ্টান্তটি তো আরও নিষ্ঠুর। লেবার পার্টির একজন বড় চাঁদাদানকারীর কাছ থেকে নিজের বাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন পিটার ম্যান্ডেলসন, কিন্তু তা তিনি এমপিদের রেজিস্টারে ঘোষণা করেননি।
পরে, লেবারবিরোধী পত্রিকা টেলিগ্রাফ তা প্রকাশ করে দেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাঁকে তখন মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল। এই রেজিস্টারের কারণে কোন এমপি কোন বিষয়ে কী প্রশ্ন করছেন অথবা কোন দিকে ভোট দিচ্ছেন, সেগুলো সম্পর্কে ভোটাররা একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পান। অবশ্য, বলে রাখা ভালো যে ব্রিটেনে যেসব সাংবাদিক পার্লামেন্টের কার্যক্রম সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহের কাজ করেন, তাঁদের জন্যও রয়েছে একটি রেজিস্টার। ১৯৮৫ সালের ১৭ জানুয়ারি পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে সাংবাদিকদের এই রেজিস্টার চালু করে। সাংবাদিকেরা যাতে মন্ত্রী ও এমপিদের কাছে অন্য কারও হয়ে লবিং করতে না পারেন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিরা ভোট দিয়ে পার্লামেন্টারি কমিশনার ফর স্ট্যান্ডার্ডস নির্বাচন করেন, যাঁর দায়িত্ব হচ্ছে এসব রেজিস্টার তত্ত্বাবধান করা এবং এমপিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করা। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ—হাউস অব কমন্স ও হাউস অব লর্ডসের জন্য আলাদা আলাদা দুজন কমিশনার এই দায়িত্বটি পালন করেন। এমপিরা ভিন্ন কোনো দেশের আতিথেয়তা গ্রহণ করলে তাঁদের সেটিরও ঘোষণা দিতে হয়। বাংলাদেশবিষয়ক অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপসহ এ ধরনের যত বিশেষ গ্রুপ রয়েছে, সেগুলোর সদস্যদের তাঁদের স্বার্থ সম্পর্কে ওই রেজিস্টারে ঘোষণা দিতে হয়। আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন যে ‘নির্বাচনী হলফনামা রাজনীতিকদের চরিত্র হনননামায় পরিণত হয়েছে’ (প্রথম আলো, ৩ মার্চ, ২০১৪)। মন্ত্রী হিসেবে পুনর্জন্মের আগে যাঁর জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে ব্রিটেনে এবং এখনো যিনি পরিবারের কারণে বছরে একাধিকবার ছুটি কাটাতে লন্ডনে আসেন, তিনি আরও বলেছেন যে এক দেশে সব মানুষের জন্য এক নীতি আর রাজনীতিকদের জন্য আরেকটি নীতি বা আইন থাকতে পারে না।
সুতরাং, জনপ্রতিনিধিদের রোজগার ও সম্পদের হিসাব দেওয়ার হলফনামার বিধান সংশোধন প্রয়োজন। ৫ জানুয়ারির প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রাপ্তি ছিল গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীনদের সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী হওয়ার আংশিক চিত্র অবলোকন। সেটা বন্ধের প্রাণান্তকর চেষ্টাও আমরা দেখেছি। কিন্তু, তা সফল না হওয়ায় এখন আইন পরিবর্তনের এই ভাবনা। ২০০৯ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেসব হিসাব সাধারণ মানুষের জন্য নয়। অবশ্য দুষ্টু লোকেরা বলে থাকেন, দলের জন্য কার কাছ থেকে কত চাঁদা নেওয়া যাবে, সেটা যাঁরা ঠিক করেন, তাঁরা ওসব হিসাব ঠিকই জানেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকেরা ক্ষমতার বদৌলতে লাইসেন্সবাজি করে ধনবান হওয়ার ধারাটি নতুন কিছু নয়। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তা করে থাকেন বেনামে। আর আমাদের দেশে অনেকেই মন্ত্রিত্বকালে স্বনামেই ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি আদায়ের বদৌলতে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এবং তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তাঁরা ক্ষুব্ধ। জনপ্রতিনিধিদের সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের ব্যবসা, ঠিকাদারি নিষিদ্ধ হলেও দিনের পর দিন সেটাই চলে এসেছে। কেননা, তাঁদের নাম শুনলে ঠিকাদার বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বা কর্মকর্তারা সাহস ও সততা দুটিই হারিয়ে ফেলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন সম্প্রতি হাতে গোনা কয়েকজন সদ্য সাবেক মন্ত্রী এবং কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। সদ্য সাবেক হওয়া এই স্বল্পসংখ্যক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। কেননা, তাঁরা যে সরকারপ্রধানের সুদৃষ্টিতে নেই, সেটা তাঁদের মন্ত্রিত্ব খোয়ানোতেই স্পষ্ট হয়েছে।
কিন্তু, মন্ত্রিত্ব ফিরে না পেলেও ক্ষমতাসীন দলে যাঁদের অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে কমিশন নিশ্চুপ। তা না হলে শাসক দলের যেসব মন্ত্রী, এমপি এবং নেতা ব্যাংক, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিভিশনসহ নানা ধরনের বাণিজ্যের লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধেই তদন্ত হওয়া উচিত। যেসব রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গত বছর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের একজনের বিরুদ্ধেও তদন্ত অনুষ্ঠানের কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তির মন্তব্যে ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। মহাজোটীয় সংসদে বিরোধী দল বলতে কার্যত কিছু না থাকায় সরকার চাইলেই দেশে বিদ্যমান যেকোনো আইন সহজেই পরিবর্তন করতে পারবে। প্রশাসন, সরকার ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে গণমাধ্যমের সীমাহীন আগ্রহ মোকাবিলার পথ হিসেবে তাঁরা চাইলে তথ্য অধিকার আইনটিও বাতিল করে দিতে পারেন। কিন্তু, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাঁদের ভেবে দেখা উচিত যে এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে। পাশ্চাত্যের উন্নত গণতন্ত্রগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু বর্তমানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু ভারতের ভালো নজিরগুলো থেকে তো শিক্ষা নেওয়া যায়। সে দেশে শুধু রাজনীতিকদেরই যে সম্পদের হিসাব দিতে হয়, তা-ই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে বলেছেন আদালত।
২০০২ সাল থেকেই সেখানে আদালতের নির্দেশে (অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস বনাম রাষ্ট্র মামলায়) প্রার্থীদের এসব তথ্য দিতে হচ্ছে। আর রাজনৈতিক দলের তহবিলের হিসাব প্রকাশ রাজনীতিকেরা দল-মতনির্বিশেষে ঠেকানোর চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কাছে টিকতে পারেননি। সৈয়দ আশরাফ এক দেশে দুই ধরনের নীতি ও আইন থাকতে পারে না বলে দাবি করেছেন। কিন্তু, ওই দাবিটি করার আগে ভুলে গেছেন যে এক দেশে দুই নীতি বা আইনের সুবিধা নিয়েই আমাদের জনপ্রতিনিধিরা শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়েছেন, সরকারি প্লট অথবা বাড়ি নিয়েছেন। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা সেগুলো ফেরত দিলেই না তিনি দুই নীতির বিরোধিতা করতে পারতেন। বহু গণতন্ত্রেই এই দুই নীতি আছে, যার মূলে রয়েছে জনপ্রতিনিধিদের জন্য উঁচু নৈতিক মান নির্ধারণ। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির এই হাতিয়ারটি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। এখন সেটাকে ছুড়ে ফেলার আয়োজন হবে ভোটারদের চূড়ান্তভাবে ক্ষমতাহীন করার উৎসব। কেননা, ভোটারের সামনে তখন শুধু মার্কা ছাড়া বিবেচনার মতো আর কী অবশিষ্ট থাকবে?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

No comments

Powered by Blogger.