তাণ্ডব ও চেতনা by মাকসুদুল আলম

কারও তাঁবেদারি না করার স্লোগানে অবিচল দৈনিক মানবজমিনের ১৭তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে দেরিতে হলেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
প্রবাসে দীর্ঘদিন পত্রিকাটির একজন নিয়মিত পাঠক। গুণগত মান, সার্বিক পরিবেশন, স্বাস্থ্য বিষয়ক ফিচার ও পত্রিকাটির গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমার খুবই পছন্দের। প্রধান সম্পাদক একজন অভিজ্ঞ পেশাদার সাংবাদিক। টেলিভিশনে চেনামুখ। সাহসী সৎ নীতিবান ও নির্লোভ বলেই অধিক পরিচিত। প্রধান সম্পাদকের সঠিক দিকনির্দেশনায় সব স্টাফের সাধনায় ট্যাবলয়েড দৈনিকটির জনপ্রিয়তা পাঠক মহলে দিন দিন বছর বছর বেড়েই চলেছে বলে আমার বিশ্বাস। দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ খুব কম। হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারা আর ক্ষমতার সুবিধাভোগের অপরাজনীতির প্রতি আকর্ষণ থাকলে আজ  হয়তো সম্পাদক নিজে সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে নিতে পারতেন। সম্পদের পাহাড় গড়তে পারতেন। খুবই স্বাভাবিক। আর  সাংবাদিক না হয়ে প্রবাসী হলে হয়তো বিদেশের মাটিতে স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। বিলেতেও বাড়ি-গাড়ি ধন-সম্পদ অর্জন করতেন। জানের ভয় নিয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরতে হতো না। তবে সমাজের অতিসাধারণ মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হতেন কি-না জানা নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত টিভির সামনে সচেতন দর্শক তার সংবাদপত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখার জন্য অপেক্ষা করত কিনা বলতে পারছি না। মানুষের ভালবাসা মনের অনেক বড় শান্তি। যে কেউ তা পায় না। ক্ষমতার জোরেও তা অর্জন করা যায় না। ধন-সম্পদ আর বিত্তবৈভবের পাহাড়ের বিনিময়েও এ শান্তির দেখা মেলে না। এ শান্তি উপলব্ধি করতে হয়।
ভাষা ও সংস্কৃতির মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসেই ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের বেডরুমে খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি। দু’বছরেও শেষ হয়নি তদন্তের সেই দু’দিন। তদন্তের অগ্রগতি জানতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছে হাইকোর্ট। ন্যায় বিচার এদেশে সোনার হরিণ। আশায় আশায় দিন যাবে। আশা পূরণ হবে না। শেষ পর্যন্ত গুঁড়েবালি পড়বে তাতে। ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষার কদর বাড়ে। ঢাকায় বসে প্রাণের বইমেলা। প্রদান করা হয় একুশে পদক। আমার এক বন্ধু বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পর এখন নাকি হাইজ্যাক হয়েছে একুশের চেতনাও। দলীয়করণ হয়েছে একুশে পদকও। বন্ধুর মতে, জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে এদেশে পত্রিকার পাতায় বাহারি বিজ্ঞাপন দেখা গেলেও তাতে স্থান পায় না মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর কথা। পাঠ্যপুস্তক থেকে উধাও হওয়ার পর এখন পত্রিকার পাতা থেকেও উধাও এই মহান নেতা। অথচ এ মাসেই ছিল ওসমানীর মৃত্যুবার্ষিকী। নব্য-চেতনার আবেগের পানিতে ধুয়ে মুছে গেছে তার সব স্মৃতি। ওদিকে এক মাসের মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সাইনবোর্ড ও ব্যক্তিগত নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগ হলে খুব ভাল কথা। আপত্তি থাকার কথা নয়। নির্দেশ প্রদানকারী উচ্চ আদালতেও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার প্রচলন হলে আরও ভাল হয়। এটা এখন জনদাবিতে পরিণত হয়েছে।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ টানছি। পরপর বিগত দু’সপ্তাহ জাপানের রাজধানী টোকিও সহ গোটা পূর্ব জাপানে তীব্র তুষারপাত হয়েছে। আবহাওয়া কর্তৃপক্ষের পূর্বাভাসের চেয়েও অনেক বেশি বরফ পড়েছে। পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে অনেককে। দু’দফায় প্রবল তুষার ঝড়ে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল টোকিওর যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যাহত হয়েছিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্থানে স্থানে ঘর-বাড়ি রেলস্টেশন ও স্টেডিয়ামের ছাদ ভেঙে পড়ে, রাস্তাঘাটে বড় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে ইত্যাদি নানা কারণে দু’দফায় সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত  হয়েছে কয়েক হাজার লোকজন। বিগত দেড় যুগেও টোকিওতে এমন তুষারপাত হয়নি। সর্দিজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। অবস্থার এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া যাক বাংলাদেশের দিকে। শুরু হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। প্রথম পর্বে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ৯৭টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ শেষ হলো। নির্বাচনকে ঘিরে জেলায় জেলায় ছিল টান টান উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা। ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। এ নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে ছিল সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিল র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী। কাগজে কলমে অরাজনৈতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও বাস্তবে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ পরিলক্ষিত হয়েছে। জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে। দুধের স্বাদ কিছুটা হলেও ঘোলে মিটিয়েছে। লড়াই হয়েছে তবে হাড্ডাহাড্ডি বলা যায় না। বিস্তারিত ফলাফল পাঠকের জানা। মান-সম্মান রক্ষার ভোটযুদ্ধে আপাতত বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয়ী হয়েছে। সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই ভোটকেন্দ্র দখল করে জালভোট প্রদান, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিএনপির ভোট জালিয়াতির অভিযোগ নির্বাচন কমিশন আমলে নেয়নি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন ‘করিম রহিমের অভিযোগ চলবে না। সেলিমের অভিযোগ আমলে নেয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের এমন দ্বৈত ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য।’ ব্যাপক কারচুপির পরও এই ফলাফল। একেবারে ভরাডুবি। অদ্ভুত নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে ৯টি উপজেলায় স্থানীয়ভাবে নিরুত্তাপ হরতাল পালিত হয়েছে। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান আরও বাড়তে পারতো। সন্দেহ নেই।
অতীত নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে নেই। বেশি দূর যাচ্ছি না। বিগত দু’বছরে আমাদের দেশে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলী মনে করলে স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নানা ছলচাতুরি ও কলাকৌশল। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার পর থেকে ঘটেছিল নানারকম লোমহর্ষক ঘটনা। গুলশানের কূটনীতিপাড়ায় খুন হয়েছিল সৌদি কূটনীতিক খালাফ আলী। মধ্যরাতে ঘটেছিল সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৭০ লাখ টাকার অর্থ কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এরপর ঘটে ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা। আগারগাঁও এলাকায় ঘটে ব্যাপক সাংবাদিক নির্যাতন। দিনদুপুরে সিএমএম কোর্ট সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ ক্লাবের ভেতরে ঘটে তরুণীর শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। এরপর জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধী দলের চিফ হুইপের পা ও মাথা ভেঙে দেয়া পুলিশের পদোন্নতি হয়। মাসখানেক  সভা-সমাবেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে চলে সরকারের মন্ত্রীদের মুখরোচক অশ্লীল কটূক্তি। এরপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি বক্তব্যকে বিকৃত করে জাতীয় সংসদে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অসম্মান করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী তার বিরুদ্ধে চলে বিষোদগার। এরপর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা ফটকাবাজ বলে বেফাঁস মন্তব্য করা হয়েছিল। একের পর এক ঘটেছিল এরকম হাজারও ঘটনা। এবারও অবস্থা অনেকটা অপরিবর্তিত। যথেষ্ট মিল রয়েছে। ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করা। হবু বিশেষ দূতকে জোর করে হাসপাতালে বন্দি করে রাখা। সাবেক বিরোধীদলীয় প্রধানকে গৃহবন্দি করে রাখা। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদলের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি লণ্ডভণ্ড করে দেয়া। অপহরণ-খুন, ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার, গুম তথা বিচারবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া। আত্মরক্ষার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। সাবেক বিরোধীদলের নেত্রীকে লেডি লাদেন বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা। বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রবাসে অবস্থানরত ছেলেকে আল-কায়েদার বাংলাদেশী এজেন্ট বলে তাচ্ছিল্য করা। হেয় করা। প্রকাশ্য গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ‘ক্যাশ চাই ক্যাশ’ বলে বেফাঁস মন্তব্য করা। সর্বশেষে আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির কথিত অডিও বার্তাটি ইন্টারনেট ব্লগে ছড়িয়ে দেয়া ও এ সংক্রান্ত ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের কাল্পনিক গাড়িবোমা তত্ত্ব আবিষ্কার করা। সব যেন একই সূত্রে গাঁথা। সুবীর ভৌমিক হয়তো সত্যিসত্যিই দক্ষিণ এশিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিতে চাইছেন। প্রতিবেদন লেখার নামে দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো রক্তাক্ত সহিংসতার বীজ বপন করতে চাইছেন। তার কল্পিত বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার তফাৎ অনেক। আগামী দিনগুলোতেও এভাবেই হয়তো ঘটতে থাকবে একের পর এক ঘটনা। সময়ের ব্যবধানে একই ছলচাতুরি ও কলাকৌশলের ভিন্ন রূপ দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাকে জড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ছলচাতুরি বলা যায় ভেস্তে গেছে। নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশন করায় সবাই তা টের পেয়ে গেছে। প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে জঙ্গিবাদ কার্ড। দাম্ভিকতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে জনগণ। না বলেছে ভয়ভীতির অপসংস্কৃতিকে। অপহরণ, খুন, ক্রসফায়ার, গুম তথা বিচারবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে তারা। ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্র হত্যাকারী এক ব্যক্তির নিরঙ্কুশ তাণ্ডবের নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্যালটের মাধ্যমে তারা চলমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিকে ধিক্কার জানিয়েছে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৪, টোকিও

No comments

Powered by Blogger.