প্রতিপক্ষ যখন আওয়ামী লীগ

ছয় কিস্তির উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফায় ৯৭টি উপজেলায় নির্বাচন হলো গত বুধবার। যে বিএনপি-জামায়াত জোট বিদেশি লবিস্ট, কিছু অদূরদর্শী দলীয় নেতার প্ররোচনায় গত ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, সেই জোটও এই উপজেলা নির্বাচনে শুধু অংশগ্রহণই করেনি, ৯৭টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের মধ্যে যৌথভাবে ৫৩টিতে জয়ীও হয়েছে। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, এটি একটি পাতানো নির্বাচন, যেখানে একতরফাভাবে সরকারি দল তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৪টি চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো করেছেন। কারচুপির অভিযোগ এনে একাধিক নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। তার প্রতিবাদে আটটি উপজেলায় আবার তারা হরতালও করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব এলাকায় তারা এই অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছে, তার মধ্যে একাধিক উপজেলায় আবার তাদের প্রার্থীরাই বিজয় লাভ করেছেন। এখন রুহুল কবির রিজভী কী বলবেন জানি না। হয়তো বলবেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে মানুষ সব আসনে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বিজয়ী করত। ইতিমধ্যে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হান্নান শাহ বলেই ফেলেছেন, প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করলে তাঁরা আরও অনেক বেশি চেয়ারম্যান পদে জয়ী হতেন। বিজয়ী প্রার্থী, নির্বাচন কমিশন আর সরকারকে প্রথম দফার উপজেলার নির্বাচনটি মোটামুটি নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন।
কোনো কোনো জায়গায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। নির্বাচন কমিশন আরও একটু সতর্ক হলে এই সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে জামায়াত-শিবির আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপি যে মাত্রায় সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল, তার তুলনায় উপজেলা নির্বাচনে সৃষ্ট সহিংসতা নস্যি। প্রথম ধাপের পর দ্বিতীয় ধাপে ১১৭টি উপজেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, তৃতীয় ধাপে ৮৩টি উপজেলায় ১৫ মার্চ, চতুর্থ ধাপে ৯২টি উপজেলায় ২৩ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, পঞ্চম ধাপে ৭৪টি উপজেলায় নির্বাচন হবে ৩১ মার্চ। আর ১২টি হবে ষষ্ঠ ধাপে। সব নির্বাচন শেষে এই নির্বাচন নিয়ে সার্বিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব। প্রথম ধাপের নির্বাচন সম্পর্কে শুধু একটি কথা বলা যায়, এই ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। যদিও এটি একটি স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচন এবং তা নির্দলীয়ভাবেই হয়, কিন্তু বাস্তবে তা দলীয় রূপই নিয়েছিল। কারণ, প্রায় সব প্রার্থীর পেছনে দলীয় ছাপ ছিল আর নির্বাচনের দিন দলগতভাবে বিএনপি তো নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়ে তাদের কথিত কারচুপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এসেছে। ভোটের দিন বিকেলে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যথাক্রমে রুহুল কবির রিজভী আর এইচ টি ইমাম নির্বাচন বিষয়ে তাঁদের দলীয় অবস্থান প্রকাশ করেছেন। সব কিস্তির নির্বাচন শেষে যদি বর্তমান ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জামায়াত জোট ভালো করে, তাহলে নিশ্চিতভাবে তারা তাদের আগের দাবির পুনরাবৃত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটার পুনরুল্লেখ করবে। এই নির্বাচনের আরও একটি তাৎপর্য আছে।
নির্বাচনের দিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা রাজশাহী জেলার কয়েকটি কেন্দ্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাঁদের দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি দল নির্বাচন চলাকালীন চট্টগ্রামে গিয়ে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।উল্লেখ্য, বুধবারের নির্বাচনে হেফাজতের সদর দপ্তর এলাকা হাটহাজারীতেও তাদের একজন প্রার্থী ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে এক অজ্ঞাত কারণে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের একটি প্রতিনিধিদল নেজামে ইসলামের একাংশের প্রধান চট্টগ্রামের মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরীর লালখান বাজারের মাদ্রাসায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কিছুদিন পর সেই মাদ্রাসায় বোমা বানানোর সময় এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে তিনজন মাদ্রাসাছাত্র নিহত হয় এবং ওই মাদ্রাসার একটি অংশ উড়ে যায়। এযাবৎ পুলিশ মুফতি ইজাহারকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ড্যান মজীনার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শন করা, একই সময় তাঁর দূতাবাসের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে একেবারে তাঁদের সদর দপ্তরে গিয়ে সাক্ষাৎ করা অথবা এর আগে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের একটি প্রতিনিধিদলের মুফতি ইজাহারের সঙ্গে দেখা করা—এসব বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। মুফতি ইজাহার যখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত একটি দলের প্রধান, তখন বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব বহন করে। প্রথম দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেকটা বিপর্যয়কর ফলাফল কী অপ্রত্যাশিত ছিল? দলকানা না হলে বলতে হয়, না, অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, বেশির ভাগ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগই ছিল;
ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ৮০টি আসনে পরাজিত হয়েছিল নিজেদের দলীয় কোন্দলের কারণে নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে। সদ্য বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যান বা অন্যদের বিজয়কে খাটো করে না দেখেও বলা যায়, এই নির্বাচনে আগের ধারাবাহিকতায় অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছেন স্রেফ দলীয় কোন্দলের কারণে। কোন্দল এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি দলীয় ট্রেডমার্ক হয়ে পড়েছে। এই কোন্দল যদি না থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে এখনো একটি অপ্রতিরোধ্য দল হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে পারত। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে দলীয় সভানেত্রী থেকে শুরু করে একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা প্রতিটি উপজেলার স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন প্রতিটি উপজেলায় একজন করে প্রার্থী দেন এবং তাঁর বিজয়ের জন্য কাজ করেন। কিন্তু তাঁদের সেই আহ্বান শুধু যে অরণ্যে রোদন ছিল, তা-ই নয়, অনেক উপজেলায় এই কোন্দলকে আরও উৎসাহভরে বাতাস দিয়েছেন হয় ওই এলাকা থেকে মনোনীত কোনো এক মন্ত্রী অথবা সাংসদ। স্থানীয়ভাবে হয়তো ঠিক করা হলো, দলীয় প্রার্থী হবেন একজন কিন্তু তাঁকে নাকচ করে দিয়ে মন্ত্রী বা সাংসদ নিজেদের এক বা একাধিক প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিপর্যয় নিশ্চিত করেছেন। চট্টগ্রামের দুটি নির্বাচনী এলাকার কথা বলি। একটিতে বিদায়ী চেয়ারম্যান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। এলাকায় তিনি বেশ জনপ্রিয় বলে জানা গেছে। কিন্তু একজন মন্ত্রী তাঁকে বোধগম্য কারণ ছাড়া নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। সেই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলেন একজন প্রার্থী এবং বললেন, এই প্রার্থীই হচ্ছে দলীয় প্রার্থী। যথারীতি বিএনপি প্রার্থীর কাছে উভয় প্রার্থীর হার।
অথচ এই প্রার্থীদ্বয়ের প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে বিএনপি প্রার্থী ধারে-কাছেও নেই। আরেকজন বিদায়ী চেয়ারম্যান, যাঁর সততা কিংবদন্তিতুল্য। বছর দুই আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে এলাকার মানুষ চাঁদা তুলে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। এবার দলীয় প্রার্থী। কিন্তু এলাকার আওয়ামী লীগের কর্মীদের অন্য চিন্তা। বিএনপি প্রার্থীর টাকাপয়সা খরচ করার যোগ্যতা অনেক বেশি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নৌকা ভিড়ল তাঁর বন্দরে। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। এমন অবস্থা খুঁজলে আরও অনেক উপজেলায় মিলবে। সামনের নির্বাচনগুলোতেও এমন হবে না, তা কেউই হলফ করে বলতে পারবে না। এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার একটি সামান্য চিত্র এবং সাম্প্রতিক কালে যখনই দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অথবা তাদের ভাবধারার কোনো পেশাজীবী সংগঠন কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন এমন কোন্দল বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং যথারীতি একটি বিপর্যয় ঘটে আর আওয়ামী লীগ সেই বিপর্যয় থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না। পাঁচ বছর অথবা দুই বছর পর হোক, আগামী কোনো একসময় একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। এখনো যদি আওয়ামী লীগ দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে কোন্দল নিরসনে সমর্থ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও যে এমন সব বিপর্যয় ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? ইতিমধ্যে যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজে দলের মন্ত্রী আর সাংসদদের কারণে হেরেছেন, তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, সামনের নির্বাচনে তাঁরা তা সুদে-আসলে পরিশোধ করে দেবেন। এমন অবস্থায় তাঁদের বিপর্যয় রোখে কার সাধ্য? দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ তার নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করে আসছে। এখন সময় এসেছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটি কে করবেন, তা কোটি টাকার প্রশ্ন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব।

No comments

Powered by Blogger.