চীন-ভারতের মধ্যে সেতুবন্ধ হতে পারে বাংলাদেশ

এম হুমায়ুন কবির।
এম হুমায়ুন কবির। কূটনীতিক। তাঁর জন্ম ১৯৫১ সালের ৭ ডিসেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরে স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষে তিনি উচ্চশিক্ষা নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর হুমায়ুন কবির এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিন দশকেরও বেশি সময় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও কলকাতায় উপহাইকমিশনারসহ বিভিন্ন উচ্চতর পদে আসীন ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এই কূটনীতিক বর্তমানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো  ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বহির্বিশ্বে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কূটনীতির দৃষ্টিতে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
হুমায়ুন কবির  গত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে একধরনের অস্বস্তি রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতিতে এর প্রভাব পড়বে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য জানতে হবে বহির্বিশ্ব কী দৃষ্টিতে দেখছে, বাংলাদেশের কাছে তাদের প্রত্যাশা কী? প্রথম প্রত্যাশা হলো, তারা বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু কোনো নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্যতা না পায় স্বভাবতই দেশের ভাবমূর্তির ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দ্বিতীয় হলো, বাংলাদেশকে তারা দেখে একটি নৈতিক মানদণ্ডে, যেমন—সারা বিশ্বে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যে শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন, সেখানে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। একই সঙ্গে গণতন্ত্রচর্চা, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে মানুষকে স্বাবলম্বী করার কারণেও তাদের কাছে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটি নির্বাচনের মাধ্যমে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তখন এ নিয়ে বহির্বিশ্বে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
প্রথম আলো  পশ্চিমা দেশসহ অনেকেই চেয়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হোক, কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ভিন্ন ছিল। তারা ‘একতরফা’ নির্বাচনকে সমর্থন জুগিয়েছে।
হুমায়ুন কবির  এখানে যে যুক্তিটি কাজ করেছে তা হলো, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে পথই অনুসরণ করা হোক না কেন, লক্ষ্যটাই আসল। ভারত মনে করেছে যে দল বা গোষ্ঠী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে, তাদের সমর্থন দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সে কারণে তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে। অন্যান্য দেশ পদ্ধতি ও লক্ষ্য দুটির মধ্যে সমন্বয় আনতে চেয়েছিল, কিন্তু ভারত লক্ষ্যটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। লক্ষ্য অবশ্যই থাকবে—শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক ও অগ্রসরমাণ বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দেশটি কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটি নির্ধারণের দায়িত্বও জনগণকে দিতে হবে।
প্রথম আলো  আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের ক্ষেত্রে যে অবস্থান নিয়েছে, বাংলাদেশের বেলায় ভারত তা-ই করেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।
হুমায়ুন কবির  কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি সব ক্ষেত্রে একরকম হয় না। সমাজ, মানুষ, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। মিসরে মুরসির সরকার গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু তারা লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেনি। বাংলাদেশে আমরা পথ হারাইনি। এখনকার নাগরিক সমাজ হলো প্রাণ। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত। গণতন্ত্র মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রধান অস্ত্রও বটে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মনে করছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যত সংহত হবে, এর আর্থসামাজিক উন্নয়ন তত ত্বরান্বিত হবে এবং উদারনৈতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।
প্রথম আলো  চীন ও ভারত আমাদের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী। এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কি যথেষ্ট ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারছে?
হুমায়ুন কবির  ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, এর সঙ্গে চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত আছে। আমাদের আমদানির দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। আর চীন প্রথম। দুটি দেশই এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির শক্তি। এর সুবিধা পাওয়ার জন্য দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে। ভারত ও চীনকে আপাতদৃষ্টিতে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলেও সহযোগিতার ক্ষেত্রও প্রসারিত। বর্তমানে ভারতে চীনের বার্ষিক বাণিজ্য ৮০ বিলিয়ন ডলারের, আগামী ১০ বছরে ২০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
গত বছর চীনের প্রধানমন্ত্রী ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে একটি অর্থনৈতিক করিডর গঠনের প্রস্তাব দিলে ভারত সানন্দে সমর্থন জানায়। এই প্রস্তাবের পেছনে বাংলাদেশেরও সক্রিয়া ভূমিকা আছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর সঙ্গে চীন ও মিয়ানমারকে যুক্ত করতে পারলে দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারবে। এবং তাতে আমরাই বেশি লাভবান হব। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই চীনের সঙ্গে নতুন যোগাযোগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। বেশ কিছু বৃহৎ প্রকল্প নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। এটি ইতিবাচক বলেই মনে করি।
প্রথম আলো  নির্বাচনের আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা জিএসপি সুবধা স্থগিত করেছে। এর পেছনে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকারের বৈরিতার বিষয়টি যুক্ত বলে অনেকের ধারণা।
হুমায়ুন কবির  জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা পুরোপুরি কারিগরি বিষয়। এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যভাবে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারিনি। তবে আশার কথা, সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা অ্যাকশন প্ল্যান দিয়েছিল, এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূসের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক প্রশ্ন আছে, সেটি কেবল সরকার নয়, কংগ্রেস, মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি, এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও নেতিবাচক ধারণা আছে।
আর বাংলাদেশের বিষয়ে যে তাদের আপত্তি, সেটি হলো নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফরকালেও সে কথা বলে গিয়েছিলেন। দুই দেশের সম্পর্ক একই সঙ্গে বহুমাত্রিক ও জটিল। চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেমন আসছে জিএসপি সুবিধা স্থগিতকরণ, তেমনি সম্ভাবনা হিসেবে আসছে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি।
প্রথম আলো  যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে।
হুমায়ুন কবির  এটি হলো একটি আলোচনার ফোরাম। কী বিষয়ে আলোচনা করব, সহযোগিতা করব, তার ক্ষেত্র। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো দেশের সঙ্গে আলোচনা করতে হলে আমাদের যে সক্ষমতা বাড়ানো দরকার, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে যে সমন্বয় থাকা দরকার, সেটি আমরা কতটা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারছি, তার ওপরই জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নির্ভর করে।
প্রথম আলো  গত সরকারের দাপুটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বিদায়কে কীভাবে দেখছেন?
হুমায়ুন কবির  আমি বলব, তিনি চেষ্টা করেছেন। অনেকটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে হননি। স্বীকার করতে হবে যে, গত সরকার যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তাতে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমাদের আরও ভালো করার কথা ছিল। এর সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন ছিল। সেই কাজটি তেমন হয়নি।
প্রথম আলো  পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ইউনূসের ব্যাপারটি ক্লোজড। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
হুমায়ুন কবির  ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আছে, সেখানে তাঁর অনুগত গোষ্ঠী আছে। কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আবর্তিত হচ্ছে, সেটি ঠিক নয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের আচরণ, শ্র্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিই বেশি সম্পর্কিত বলে মনে হয়।
প্রথম আলো  দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
হুমায়ুন কবির  বিভিন্ন সভা-সেমিনার উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে যাই। অনেকে প্রশ্ন করেন। সম্প্রতি নেপালের একটি প্রতিনিধি সেমিনারেও এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। তাঁরা জানতে চাইছেন, এই সরকার কতটা স্থিতিশীল? আরেকটি নির্বাচন হবে কি না? বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের প্রশ্ন কাম্য ছিল না। যদি তাঁরা প্রশ্ন করতেন, এখানে কত বিনিয়োগ আসছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেমন হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছে কি না, খুশি হতাম।
প্রথম আলো  মার্কিন কংগ্রেস কমিটি, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে প্রস্তাব নিয়েছে। আবার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি কি স্ববিরোধী?
হুমায়ুন কবির  না, স্ববিরোধী নয়। তারা তো বিভিন্ন বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের মানুুষের কষ্ট হয় এমন পদক্ষেপ তারা নেবে না। বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ হোক, এগিয়ে যাক—এটাই তাদের প্রত্যাশা। সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ কারণেই তারা আরেকটি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। সরকার প্রতিদিনের কাজ করে। আমাদের দেশে সরকার ও সংসদের যে সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনে তা নয়। সেখানে ক্ষমতার বিভাজন আছে। সংসদ অনুমোদন না করলে সরকার কাজ করতে পারবে না। তাই দেখবেন মার্কিন প্রশাসন ও কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য আছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা নেই, কমিশনে আছে। তাই নৈতিক চাপটি উপেক্ষা করা যায় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রশাসন জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না, আর সেই জনমতের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো পার্লামেন্ট। এটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতি।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
হুমায়ুন কবির  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.