মানবাধিকার দিবসের প্রত্যাশা by কাজী ফারুক আহমেদ

সিরিয়া, আফগানিস্তান, মিয়ানমারসহ দেশে দেশে মানবাধিকার লংঘন, বাংলাদেশে ক্ষমতার জন্য রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা ও খেটে-খাওয়া, অসহায় মানুষের জীবনযাত্রায় চরম দুর্ভোগের প্রেক্ষাপটে এসেছে এবারের মানবাধিকার দিবস। আজীবন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত নেলসন ম্যান্ডেলার মহাপ্রয়াণ এর বিশেষ প্রেক্ষাপট রচনা করেছে। ‘সর্বজনীন মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে ১৯৬৮ থেকে পালিত হয়ে আসা আজকের দিনটি (১০ ডিসেম্বর) মানুষের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদার অপরিহার্যতা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছে। উল্লেখ্য, প্রতি বছরের মতো এবারও দিবসটির একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা হল- ‘দুই দশক ধরে অধিকারের সপক্ষে কার্যক্রম’। দিবসের পটভূমি : ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা গৃহীত হয়। এই ঘোষণায় মোট ৩০টি ধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নির্যাতন থেকে দেশে আশ্রয় চাওয়া ও আশ্রয় লাভ, ভয়, অভাব, নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অধিকার। ঘোষণার ২৩ অনুচ্ছেদের ৩ ধারায় আছে : ‘কর্মরত প্রতিটি মানুষের কাজের ন্যায্য ও সন্তোষজনক পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার আছে- যা পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মান ও মানবিক মর্যাদার সঙ্গে তার জীবনযাপন নিশ্চিত করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রয়োজনমতো অন্যবিধ সামাজিক সুরক্ষা।’ ২৪ অনুচ্ছেদে আছে : ‘প্রত্যেকেরই যুক্তিসঙ্গত শ্রমঘণ্টার সীমারেখা ও প্রচলিত নিয়মে বেতন-ভাতাসহ বিশ্রাম ও অবকাশ ভোগের অধিকার আছে।’ ২৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত : ‘প্রত্যেকেরই শিক্ষা লাভের অধিকার আছে।’
দুই দশকের অর্জন : মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ এ বছর গত দুই দশকের অর্জনগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। ১৯৯৩ সালের ২৫ জুন ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনে ৭ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের পদ সৃষ্টি ও কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এর পেছনে বড় উদ্যোগ ছিল বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা/সংগঠনের। লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন ও কার্যকর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যার মূল কাজ হবে যেখানেই মানবাধিকার লংঘিত হবে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। জাতিসংঘের শক্তি ও প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য প্রযোজ্য অধিকার নিশ্চিত করা। দুই দশক ধরে এক্ষেত্রে অর্জিত ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এবারের মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য স্থির করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এসব অর্জনের মধ্যে রয়েছে : ১. কোনো ভেদাভেদ না রেখে সব মানুষের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং উন্নয়নের অধিকারের স্বীকৃতি; ২. বিশ্বব্যাপী শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মানবাধিকারের স্বীকৃতি; ৩. শিশু, নারী, নির্যাতনের শিকার সব মানুষ, অক্ষম/বিশেষ চাহিদা প্রাপ্তির যোগ্য ব্যক্তি ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা লাভের অধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি; ৪. নারীর অধিকার মানবাধিকারের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি এবং নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংস আচরণ মানবাধিকারের প্রত্যক্ষ লংঘন হিসেবে স্বীকৃতি। ৫. মানবাধিকার লংঘন করে কেউ পার পেতে পারবে না, নির্যাতিতের সুবিচার লাভের অধিকার, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারীদের আইনের আওতায় বিচারের অধিকার; ৬. প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদার মানুষদের সমঅধিকারের স্বীকৃতি; ৭. অভিবাসী ও অপর্যাপ্ত কাগজপত্র নিয়ে বিদেশে গমনকারী অভিবাসনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের বাধাগুলো দূরীকরণের উদ্যোগের স্বীকৃতি; ৮. আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় ও বৈষম্যহীন সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা/কার্যক্রমের স্বীকৃতি; ৯. বিশ্বব্যাপী মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার সপক্ষে সচেতনা বৃদ্ধিতে নাগরিক সমাজের অবস্থান ও সৃজনধর্মী উদ্যোগের স্বীকৃতি; ১০. জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর স্বাধীন কার্যক্রম গ্রহণ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশে এ ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা; ১১. অতীতে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত, মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের পূর্ণ মানবাধিকার; ১২. ব্যবসা-উদ্যোগে মানবাধিকার প্রসঙ্গের যুক্তকরণের সপক্ষে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা; ১৩. স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারের প্রতি সমর্থন ও একই সঙ্গে যা প্রত্যক্ষভাবে হিংসা বা সন্ত্রাসে উস্কানি দেয় তার বিরোধিতা জ্ঞাপক নীতিমালা নির্ধারণ; ১৪. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা/সংগঠনগুলোর প্রবীণদের অধিকার, সত্যের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণের অধিকার, নির্মল পরিবেশ, বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানীয় এবং স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশনের অধিকারের স্বীকৃতি।
বাংলাদেশে মানবাধিকার : এখানে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, যার মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা দুজনই। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে এখন মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। শিক্ষকতায় বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তবে শিক্ষার্থী হিসেবে মেয়েরা যখনই উঁচু ধাপে উঠতে যায়, তখনই তাদের ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। কোথায় নেই আমাদের নারীরা? শিক্ষকতায় তো আছেই। সাংবাদিকতা, শিল্প উদ্যোগ, ব্যবসা- প্রায় সর্বত্রই তাদের বিচরণ। বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষ পদেও রয়েছে তাদের অবস্থান। বৈদেশিক দূতাবাস, সামরিক ও আইন-শৃংখলা বাহিনীতেও তাদের অবস্থান একেবারে অনুল্লেখযোগ্য নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আগের সরকারের আমলে নিবন্ধন, সনদপত্র, ব্যাংক হিসাবসহ সব ক্ষেত্রে বাবার নামের সঙ্গে মায়ের নামও যুক্ত করেন। এবার মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এসবই এক একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আমাদের মেয়েরা এখন হকি, ক্রিকেট, ফুটবল খেলছে। সাঁতার, বন্দুক চালনায় নৈপুণ্য দেখিয়ে দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কারও এখন তাদের করায়ত্ত। তবে এরপরও বাংলাদেশে পরিবারে নারীর শ্রমের ও উদ্যোগের মূল্যায়ন নেই। নারী শ্রমিকের পারিশ্রমিক পুরুষের অর্ধেক অথবা তারও কম।

No comments

Powered by Blogger.