সব পক্ষকেই জয়ী হতে হবে by ড. মাহবুব উল্লাহ্

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিরোধীদলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচিতে গোটা দেশ অচল হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা চলে। রাজধানী ঢাকাতেও চলছে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা। পুলিশের গুলি ও সহিংসতার ফলে সর্বশেষ পর্যায়ে ৫০ জনের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। প্রতিটি প্রাণ অমূল্য। কোনো ক্ষতিপূরণেই এসব জীবনের মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক হল পেট্রল বোমার আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর অবস্থা। এদের মধ্যে বেশ ক’জনের মৃত্যু ঘটেছে। অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিুমুখী হবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনেও নেমে এসেছে বিপর্যয়। বিগত সময়ে, বিশেষ করে গত তিন দশকে বাংলাদেশে অর্থনীতির চাকা গতি পেয়েছিল। এ ধারা চলতে থাকলে কিংবা আরও একটু বেগবান হলে অল্প ক’বছরের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে পারত। কিন্তু তা কী করে হবে? আমাদের সংঘাতময় রাজনীতি উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে রয়েছে সুশাসনের অভাব। সুশাসন না থাকায় বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এখানে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের একটি স্কুলের পরিচালনা কমিটি নিয়ে যে নোংরা রাজনীতির চর্চা হয়, তার ফলে চরম মূল্য দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। শুধু শিক্ষা ব্যবস্থাই নয়, রাষ্ট্রের অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেমন- পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেভাবে অনাচার ও দলীয়করণ শিকড় গেড়েছে তাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাহত হতে হয়। এর মধ্যেও বাংলাদেশের উদ্যোগী মানুষ যেভাবে নানা ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগ নিচ্ছেন সেটাই বাংলাদেশকে অনেক স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। ডগলাস সি নর্থের মতো অর্থনীতিবিদরা যখন বলেন, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তম্ভ, তখন ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের উন্নয়ন একটি Paradox-এর জিন্ম দেয়। আসলেই এটি একটি Paradox। অসুস্থ রাজনীতি ও অগ্নিদগ্ধ গীতা রানী সরকারের ভাষায়, অসুস্থ সরকারের পরিবর্তে যদি সুস্থ রাজনীতি ও সুস্থ সরকার থাকত তাহলে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি কিছু অর্জন করতে পারতাম।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু সেই গণতন্ত্র অনুদার। এখানে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন এলেই সমস্যার উদ্ভব হয়। এবারকার সমস্যাটি সবচেয়ে ভয়াবহ। ১৯৯৫-৯৬ সাল এবং ২০০৬-০৭ সালে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সংকটকালেও আমরা ভয়াবহ সংঘাত-সংঘর্ষ দেখেছি, সহিংসতা দেখেছি। এবার সমস্যা আরও অনেক বেশি প্রকট। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে দেয়ার জন্যই এ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে চালু করা হয়েছিল আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে। সেই আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস দিন দিন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। যতদিন এই আস্থাহীনতা কাটিয়ে না ওঠা যাবে ততদিন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে যতই অগণতান্ত্রিক বলা হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সেটিকে বহাল রাখতে হবে। একে এক ধরনের স্টপ গ্যাপ এরেইনমেন্ট বলা যায়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, তিনি সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করবেন। কিন্তু সম্ভবত এর একদিন পরই তিনি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে দিলেন। সেদিন থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। বিরোধীদলীয় জোট চাইল তফসিল পিছিয়ে দিতে। কিন্তু তা হল না। বিরোধীদলীয় জোট নির্বাচনে এলো না। এরশাদের জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যোগ দিলেও পরবর্তী সময়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াল। তারা বলল, তফসিল না পেছালে এবং সব দল অংশগ্রহণ না করলে তারাও নির্বাচনে যাবে না। কার্যত নির্বাচনটি একদলীয় নির্বাচনে পরিণত হতে চলেছে। এর ফলে যে সমস্যা হবে, এ কথা সরকারের অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও বলেছেন। সরকার নিজ অবস্থানে অনড়। বিরোধীদলীয় জোটও অনড়। কারও পক্ষ থেকে ছাড় দেয়ার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখছি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি সর্বোচ্চ ছাড় দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু কোনো ছাড়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থায় পড়ে গেছে বাংলাদেশ।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে কী কথা হয়েছে তা আমরা জানি না। তবে এরশাদের সঙ্গে যে আলাপ হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরশাদের মুখ থেকেই জানা গেছে। সুজাতা সিং এরশাদকে নির্বাচনে থাকতে অনুরোধ করেছেন, অন্যথায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে বলে সাবধান করেছেন। এই জঙ্গিবাদের ধারক-বাহক হবে জামায়াত-শিবির। বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় অবস্থানটি এখন স্পষ্ট। ভারত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার দেখে স্বস্তিবোধ করে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলেও ভারতের ধারণা। সোজা কথায়, ভারত তার সব ডিম একটি ঝুড়িতেই রাখতে চায়। কিন্তু সেই ঝুড়ির তলা শূন্য কিনা সেটা ভেবে দেখছে না। অনেকেই মনে করেন, ভারতের এ অবস্থান আওয়ামী লীগ সরকারকে অনমনীয় করে ফেলেছে। হাজার হলেও ভারত বিশাল শক্তিশালী দেশ। বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন প্রতিবেশীও বটে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে ভারতের তুলনায় অন্য কোনো শক্তির সামর্থ্য মেলে না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সমস্যার মূলে এটি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে একই ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এখন বাস্তব অর্থেই অভ্যন্তরীণ থাকছে না।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসেছেন সবশেষে। তার সঙ্গে রয়েছে একটি শক্তিশালী টিম। এই টিমে রয়েছেন নিগোসিয়েশন এক্সপার্ট রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। তারানকো ঢাকায় ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। তিনি ঢাকায় অবস্থিত কিছুসংখ্যক বিদেশী রাষ্ট্রদূত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জামায়াত নেতাদের সঙ্গেও কথা বলবেন। তার সঙ্গে থাকা বিশেষজ্ঞরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন সবার বক্তব্যে কোনো অভিন্ন অবস্থান আছে কিনা। সেটাকে সূত্র ধরেই তারা আরও আলোচনা করবেন। শেষ পর্যন্ত কোনো ফল হবে কিনা তা কেবলমাত্র ভবিতব্যই জানে।
যদি শেষ পর্যন্ত সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হয়, তাহলে বাংলাদেশকে অধিকতর অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়তে হবে। জরুরি অবস্থা জারির কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও এ পদক্ষেপটি সংবিধানসম্মত, তবুও এই পদক্ষেপের ফলে সমস্যার সুরাহা কতটুকু হবে বলা মুশকিল। কোনো একটি দৈনিক পত্রিকায় ক’দিন আগে দেখলাম জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু নিঃসন্দেহে ভালো দৃষ্টান্ত হবে না। ড. কামাল হোসেন মনে করেন, সংবিধানের মধ্যেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু সেই ফর্মুলাটি কী সেটা তিনি স্পষ্ট করেননি। সে কথাটি খুলে বললে সমাধান যদি দূরে চলে যায় তাহলে খোলাসা না করাই ভালো। বিষয়টি মিস্টার তারানকো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার গোচরীভূত হলেই হল।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকটটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবেই এর ফয়সালা করতে হবে। দোষারোপের রাজনীতির চর্চা করে, দমন-পীড়নের পথ ধরে কোনো সমাধান হবে না। আমরা তো সবাই বাংলাদেশের মানুষ। সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষে যারা আছেন তারাও বাংলাদেশের মানুষ। জনগণ এই সংকটের আশু সমাধান চায়। তারা সংঘাত চায় না। তারা আশা করে, সব প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ সবার জন্য সম্মানজনক একটি সমাধানে পৌঁছবে। যত বিরোধই থাকুক না কেন, মনে রাখতে হবে, সবার উপরে দেশ। কেউ কাউকে নির্মূল করে জয়ী হতে পারবে না। জয়ী হতে হলে সবাইকেই জয়ী হতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.