সংবিধান ও গণতন্ত্র—কোনো নামেই অশান্তি নয়

গতকাল ‘সরকারি অবরোধ’ চলাকালে বিরান
গাবতলী বাস টার্মিনাল ছবি: সাজিদ হোসেন
১৮-দলীয় জোটের নেতা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আজ ঢাকা অভিমুখে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার কর্মসূচি দিয়েছেন। তিনি তাঁদের এই কর্মসূচির নাম দিয়েছেন ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’। জাতীয় পতাকা হাতে সবাইকে ঢাকায় দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমবেত হওয়ার অনুরোধ করেছেন। তিনি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলতে এবং গণতন্ত্র, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনকে ‘হ্যাঁ’ বলতে ওই সমাবেশ আহ্বান করেছেন। অন্যের বিঘ্ন না ঘটিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা এবং সভা-সমাবেশ করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। সেদিক থেকে তাঁর ওই সমাবেশ আহ্বান গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ ও সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি মহাজোট তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। তারা দলীয় কর্মীদের ‘পাড়া-মহল্লায়’ ওই কর্মসূচি প্রতিহত করতে নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন থেকে সভা-সমাবেশের অনুমতি নেওয়াই বিধি। ১৮-দলীয় জোট থেকে তার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে যথারীতি আবেদন করা হয়। মহানগর পুলিশ সমাবেশ করার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, ‘জননিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।’ অন্যদিকে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বাধা দিতে শুক্রবার থেকেই ঢাকামুখী বিভিন্ন রুটের বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন বাস-লঞ্চ মালিক ও শ্রমিকনেতারা। তাঁদের দাবি, অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাস ভাঙচুর করা হয়।
তাই তাঁরা দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের এ দাবিও অযৌক্তিক নয়। ঢাকা অভিমুখে অভিযাত্রার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ শুক্রবার থেকেই প্রায় বিচ্ছিন্ন। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের অসুবিধা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় দেশের কত শতাংশ মানুষ অংশ নেবেন, সে সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। কিন্তু প্রতিদিন কোটি কোটি সাধারণ মানুষ দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জীবিকার জন্য ও বিভিন্ন প্রয়োজনে যাতায়াত করেন। ঢাকা অভিমুখে অভিযাত্রা ঠেকাতে বাস-লঞ্চ বন্ধ রাখা এবং ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার। বিরোধী দলের কর্মসূচিকে বানচাল করতে গিয়ে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করা ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে হরণ করা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। এসব খুবই নিন্দনীয় ও নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সভা-সমাবেশ, লংমার্চ, মানববন্ধন প্রভৃতি বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়।
বিরোধী দল আন্দোলনের নামে সহিংসতায় অভ্যস্ত। গত কয়েক মাসে বিরোধী দলের, বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তারা রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলেছে। মহাসড়কের পাশের গাছপালা উজাড় করে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যানবাহনে আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। রেলগাড়িকে লাইনচ্যুত করেছে। বাসে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। এসব ফৌজদারি অপরাধ ও সহিংসতা প্রতিরোধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের যথেষ্ট তৎপর দেখা যায়নি। সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্কতা তো ছিলই না। নেতারা তাঁদের এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে জীবন যাপন করছেন। আজকের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ‘শান্তিপূর্ণ’ হবে বলেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়েই খালেদা জিয়া তাঁর জোটের নেতাদের নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বড় বড় সমাবেশ করেছেন। সুতরাং আজকের সমাবেশটি তাঁকে শান্তিপূর্ণভাবে করার সুযোগ দিলে সরকারের ক্ষতি হতো না।
একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে সরকার সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ১৮-দলীয় জোটের এই গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বিচিত্র কৌশলে বাধা দেওয়ার একটিমাত্র কারণই থাকতে পারে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকলে যদি খালেদা জিয়ার সমাবেশে বিপুল জনসমাগম হতো, তাহলে তা হতো মহাজোটের জন্য বিব্রতকর। তাতে প্রমাণিত হতো, জনগণ ৫ তারিখের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছে। সেই সুযোগটি ১৮ দলকে সরকার দিল না। এখন যখন বেশি লোকের জমায়েত হবে না, তখন মহাজোটের মুখপাত্ররা সাংবাদিকদের বলতে পারবেন যে খালেদার ডাকে মানুষ সাড়া দেয়নি। তারা একটি জিনিস বোঝার প্রয়োজন বোধ করেনি যে দলীয় কার্যালয়ের সামনে না গিয়ে ঘরে বসেও কোনো কর্মসূচিতে সমর্থন দেওয়া যায়। একাত্তরে টিক্কা খান ও ফরমান আলীদের সামরিক জান্তা স্বাধীনতাকামীদের কোথাও সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি। তাতে প্রমাণিত হয়নি যে মানুষের মুক্তিযুদ্ধে কোনো সমর্থন নেই। যদিও পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নেতারা সে কথাই বলেছেন। বিএনপির বড় বড় নেতা-কর্মী মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই কারাগারে। কেউ আত্মগোপন করে আছেন গ্রেপ্তার ও রিমান্ড এড়াতে। দু-চারজন যাঁরা সরকারের দয়ায় বাইরে আছেন, তাঁরাও দলের কার্যালয়ে ঢুকতে পারছেন না। ছোট নেতা-কর্মীরা দলের কার্যালয়ের ত্রিসীমানায় যেতে পারছেন না।
গেলেই গ্রেপ্তার বা লাঠিপেটা, এই অবস্থাটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কোনো গণতান্ত্রিক দলের নেতা যখন কোনো অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে ভিডিও বার্তায় তাঁর কথা প্রচার করেন, তা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে কী বার্তা দেয়? আশা করি, সরকারি দলের নীতিনির্ধারকেরা তা ভালো বোঝেন। খালেদা জিয়া তো সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, যে সংসদ এখনো জীবিত। ২৪ জানুয়ারির আগে তার বিলুপ্তির সম্ভাবনা কম। শুক্রবার বেগম জিয়া এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আমি আপনাদের পাশে আছি। থাকব সব সময়। যদি আমি আপনাদের পাশে থাকতে না পারি, তাহলেও আপনারা এ কর্মসূচি, এ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ সরকার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এ দেশে আমরা গণতন্ত্র এনেছি, আবারও গণতন্ত্র আনব। সেদিন আর বেশি দূরে নেই। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।’ ‘যদি আমি আপনাদের পাশে না থাকতে পারি’—কথাটির অর্থ কী? তিনি ‘নিজের বাসায় রয়েছেন’।
তাঁর সঙ্গে তাঁর দলের নেতাদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। কলকাতার টিভি চ্যানেলের সংবাদে বলা হয়েছে, তিনি ‘গৃহবন্দী’। বাংলাদেশি গণতন্ত্রের অনেক জঘন্য দৃষ্টান্তের সঙ্গে আরও একটি খারাপ দৃষ্টান্ত যোগ হলো। তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখায় মানুষের সমর্থন তাঁর প্রতি কিছুমাত্র কমার সম্ভাবনা নেই। ২৯ ডিসেম্বর নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। বিরোধী নেতা-কর্মীদের থেকে সংযত আচরণই কাম্য। সরকারের এতটা আগাম তৎপরতা দেখানোর দরকার ছিল না। আগে বিরোধী দলের অবরোধে হয়েছে জনজীবন দুর্বিষহ। এখন সরকার বন্ধ্ ঘোষণা করে দুর্ভোগে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। তবে দুর্ভোগ ও দুর্দশা যতই হোক আমাদের আশা, দিনটি শান্তিপূর্ণভাবেই অতিবাহিত হবে। সংবিধানের নামেই হোক বা গণতন্ত্রের নামেই হোক—অশান্তি মানুষ চায় না। বিরোধী ও সরকারি উভয় পক্ষের কাছেই এই আমাদের আবেদন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.