শর্শিনা, আটরশি থেকে হাটহাজারী

গণতান্ত্রিক শক্তির অনৈক্যই পতিত
শাসকের রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছে
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। পাশাপাশি তারা অন্য ধর্মমতের প্রতি সহনশীল। দেশটির জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই মুসলমান। তাদের একটি বড় অংশ অলি-আউলিয়াদের মাজার জিয়ারত করে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও সেসব মাজারে এসে প্রার্থনা করে। আবার মুসলমানদের অনেকেই যান পীর-দরবেশদের কাছে। এমন বিশ্বাসের প্রতি বৈরী একটি শ্রেণীও রয়েছে।
এ সত্ত্বেও এসব বিশ্বাসে তারা তেমন ফাটল ধরাতে পারেনি। উল্লেখ করা যায়, এ ভূখণ্ডে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অলি-আউলিয়াদের নিরলস ভূমিকা কাজ করেছিল। আচরণের দিক থেকে তাঁরা ছিলেন অন্য ধর্মমতের প্রতি সহনশীল ও মধ্যপথাবলম্বী। তাই কেউ কোনো বিশ্বাস থেকে এ ধরনের মাজারে যাওয়াকে দোষণীয় বলা যাবে না। ইসলাম ধর্মের বিধানাবলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন পীর, আলেম, ওলামারা। তাঁরা নিরন্তর চর্চা করেন এসব বিধান অনুসরণের। সুতরাং এসব জানতে ও শিখতে তাঁদের দরবারে যাওয়ায়ও আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, যখন এসব দরবার রাজনৈতিক ভূমিকায় থাকে, তখন। আবার কোনো রাজনীতিক যখন এসব দরবার ব্যবহার করেন, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অতি সম্প্রতি দেখা গেল, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে সেখানকার অধ্যক্ষ ও হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা শফীর দোয়া নিচ্ছেন। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি আন্দোলন হেফাজতে ইসলাম। তার নেতা আল্লামা শফী। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর অনেক অনুরাগী-সমর্থক আছেন। তবে তাঁর দু-একটি বিতর্কিত বক্তব্য আর গত মে মাসে তাঁদের আন্দোলনটি বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। আর তাঁদের ১৩ দফা দাবির বিষয়টি গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ। এসব দাবির বেশ কিছু সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দোয়া নিতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় গেলে এসব দাবি সুবিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তাঁর দল দেশের প্রধান দুটি দলের কাছেই সমাদৃত। তাঁর অতীত বলে, তিনি কথা দিয়ে সাধারণত কথা রাখেন না। এটা আল্লামা শফীসহ তাঁর অনুসারীরা নিশ্চয় ভালোভাবে জানেন। জানেন এ পতিত শাসকের ইতিহাস। তা সত্ত্বেও একজন ধর্মীয় নেতা তাঁকে দোয়া করলেন।
কার্যত সমর্থন করলেন তাঁর রাজনীতি। অন্তত সাধারণ মানুষ তা-ই ধরে নেয়। অবশ্য পরে হেফাজতে ইসলামের নেতা বাবুনগরী বলেছেন, ‘এরশাদ বদদোয়া নিয়ে গেছেন।’ এটা অবশ্য অভিনব নয়। এ শাসকের সময়কালে আমরা তাঁকে আটরশি দরবার শরিফে বারবার যেতে দেখেছি। তখনকার গদিনশিন পীর তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এমনটাই জনরব ছিল। ব্যাপারটা অনেকটা দৃশ্যমানই ছিল, এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাঁর শাসনকালে এ শাসক কী করে বেড়াতেন, তা এ দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। আটরশি দরবার শরিফের তদানীন্তন পীর একজন কামেল লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ইন্তেকালের পরেও তাঁর দরবার শরিফে হাজার হাজার অনুরাগী এসে থাকেন। এত মানুষ যাঁকে বিশ্বাস ও সম্মান করেন, তাঁকে সবারই সম্মান করতে হয়। তবে সেই দরবার শরিফে এরশাদের অস্বাভাবিক ঘন ঘন গমন ও অবস্থানে লাভবান হয়েছেন তিনি। প্রশ্নের সামনে নিয়ে এসেছেন একজন সাধককে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে এ দরবার শরিফে অবস্থানকালীন তিনি আকস্মিক একটি ‘পুত্রসন্তান জন্মের’ খবর ঘোষণা করেন। খবরটি সাদামাটা। আর অস্বাভাবিক কিছুও নয়। তবু সংগত কারণে দেশবাসী এটা বিশ্বাস করেনি। তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে এসব মিথ্যাচার নিয়ে। বেআইনিভাবে ক্ষমতা আরোহণ করে এ শাসক নয় বছর টিকে ছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তিনি জাতির বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে কখনোই সক্ষম হননি। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রতি ধর্মীয় নেতাদের দোয়া শুধু এ দুটি ক্ষেত্রে নয়, আরও অনেক ক্ষেত্রেই থাকে। দেশে পীর, দরবেশ অনেক আছেন। তবে সবাই সমান খ্যাতি অর্জন না করায় এসব বিষয় গণমাধ্যমের নজর এড়িয়ে যায়। একটু পেছনের ইতিহাসে যেতে হয়। একসময় খ্যাতনামা ছিল পিরোজপুর জেলার শর্শিনা দরবার শরিফ। এটা শতাব্দীপ্রাচীন। পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়টিও সমধিক প্রচারিত। বরাবর তারা অবস্থান নিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে। মোনায়েম খান সেই দরবারে গেছেন অনেকবার। আইয়ুব খানও একবার গেছেন। উল্লেখ করা যায়, শর্শিনা দরবার শরিফে বংশানুক্রমে গদিনশিন হয়েছেন অনেকে। তাঁরা ইসলামি শিক্ষা প্রসারের জন্য অবদানও রেখেছেন। এ ধরনের দরবার শরিফে অর্থবিত্তও আসে প্রচুর। হয়তো বা অনেক ক্ষেত্রেই জনকল্যাণকর কাজে ব্যয় হয় এসব টাকা। কিন্তু নগদ জমা টাকার পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে বিস্ময়করভাবে বেশি। এ বিষয়ে একটি তথ্য পাওয়া যায় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত শেষ ইংরেজ আইসিএস কর্মকর্তা হ্যাচ বার্নওয়েলের আত্মজীবনী থেকে। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় তিনি বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সেই বরিশাল জেলা ছিল আজকের বরিশাল বিভাগ। ছয়টি জেলার সমন্বয়ে গঠিত। পিরোজপুরও তার একটি।
দেশ বিভাগের কিছুদিন পর পুরোনো ১০০ টাকার নোট বাতিল করে ট্রেজারি থেকে নতুন নোট দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, নির্ধারিত দিনে জেলার একজন প্রখ্যাত পীর পুরোনো ১০০ টাকার নোটভর্তি অনেক বস্তা বড় নৌকায় ভর্তি করে পাল্টানোর জন্য জেলা সদরে পাঠান। একাত্তরে শর্শিনা দরবার আলোচনার দাবি রাখে। তখন এ দরবার, সংলগ্ন মাদ্রাসা, ছাত্রাবাসসহ সব স্থাপনা একটি ক্যান্টনমেন্টের রূপ নেয়। এখানকার ছাত্ররা রাজাকার ও আলবদরে যোগ দিয়ে এখানেই প্রশিক্ষণ নিত। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মানবতাবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হতো। উল্লেখ্য, এ পিরোজপুর তখন ছিল একটি মহকুমা। মহকুমা পুলিশের কর্মকর্তা পাকিস্তান হানাদারদের হাতে নিহত হন। তাঁরই কৃতী সন্তান হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ। তাঁরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যেকোনো সময় হানাদারদের হাতে পড়তে পারেন। পরিবারটির একজন শুভাকাঙ্ক্ষী শর্শিনা দরবার শরিফের মুরিদ ছিলেন। এ দুই ভাইকে তিনি পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন সাময়িক আশ্রয়ের জন্য। ব্যর্থ হয় সেই সজ্জন ব্যক্তির প্রচেষ্টা। স্বাধীনতার পর গদিনশিন পীর গ্রেপ্তার হন দালাল আইনে। মুক্তি লাভ করেন বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার আওতায়। ‘কৃতজ্ঞ জাতি’ সেই পীর আলহাজ মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে ১৯৮০ সালে শিক্ষার জন্য দেয় স্বাধীনতা পদক। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সে বছর শিক্ষার জন্য পুরস্কার আরেকজন পেয়েছিলেন, মরণোত্তর। তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। নির্মম পরিহাস। পীর, অলি, আউলিয়া, গাউস, কুতুব, আলেমরা সমাজের শিরোমণি।
তাঁদের দলমত-নির্বিশেষে সবাই সম্মান করেন। তাঁরাও গুটি কয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো বিতর্কিত বিষয়ে নিজেদের জড়িত করেন না। তবে ইসলামের বিধিবিধানের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন অবশ্যই মতামত দেবেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রনেতাদের বিবেচনায় রাখতে হয়, দেশটি জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সবার। সুতরাং সব পক্ষ সংযত না হলে অকারণ সংঘাত বাড়ায়। আর এসব অনৈক্য ও সংঘাতের সুযোগ নেয় একশ্রেণীর কুচক্রী রাজনীতিক। তাঁরা ধর্মের দোহাই দেন। তাঁদের দাবির প্রতি সহানুভূতি দেখান। তবে অনেকের ব্যক্তিগত জীবন ধর্মের মৌলিক আদর্শের বিপরীতে। আমাদের দেশটিতে ৪৩ বছরে এ ক্ষতিকর কাজটি করে চলছে কিছু লোক। এর আগেও তারা করেছিল। এরা সুযোগ পায় ও সংহত হয় গণতান্ত্রিক শক্তির অনৈক্যের কারণে। আমাদের দুর্ভাগা দেশটিতে বরাবর তা-ই ঘটে চলছে। গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে এমনটা ঘটত না। অন্যদিকে, যাঁরা স্বাধীনতার চেতনা আর উদার সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবিদার, তাঁদের কারও কারও অগণতান্ত্রিক আচরণ নজরে আসার মতো। প্রশ্ন আসে, তাঁরা নিজেরাই কি সে চেতনায় বিশ্বাসী? তাঁদেরও কেউ কেউ ধর্মীয় নেতাদের দোয়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেন। পেলে ধন্যও হন। এরই সুযোগ নিয়ে ধর্মকে রাজনীতিতে নিয়ে আসতে চায় কিছু লোক। তাদের সমর্থন দেয় রাজনীতিবিদদের একটি অংশ। তাই এমনটা হয়। না হলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে শর্শিনা দরবারের রাজনৈতিক আধিপত্য ধুলায় লুটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার স্থান আবার একই রূপে অন্য দরবার লাভ করে কীভাবে? ঠিক তেমনি গণতান্ত্রিক শক্তির অনৈক্যই গণ-অভ্যুত্থানে পতিত শাসকের রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছে আড়াই দশক। আর এ ধরনের অনৈক্য চলতে থাকলে এগুলো আরও জোরদার হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.