শেয়ারবাজার ও সরকার
গত রোববার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নিজস্ব ভবনের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেয়ারবাজার সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করবে না। তিনি বলেছেন, শেয়ারবাজারের সঙ্গে সরকারের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই। গত পাঁচ বছরে শেয়ারবাজার নিয়ে সরকারের বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কতটা সমর্থন করে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে। শেয়ারবাজারের সঙ্গে যদি সরকারের সম্পৃক্ততাই না থাকবে, তাহলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশই (আইসিবি) বা কেন এর অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী হলো? কেনই-বা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হঠাৎ করে কমিয়ে দেওয়া হলো? এমনকি বাজার যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল, তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ব্যক্তির মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের প্রস্তাব করা সত্ত্বেও সরকার নাকচ করে দিয়েছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই, শেয়ারবাজার একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। এতে লাভের সুযোগ যেমন থাকে, তেমনি লোকসানের ঝুঁকিও কম নয়। তদুপরি বাংলাদেশের মানুষের হুজুগে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতাও রয়েছে। কিন্তু সেই হুজুগকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই? নাকি হুজুগ উসকে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব? শেয়ারবাজারের সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা না থাকলে রোড শো করে, গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ব্রোকারেজ হাউস খুলতে কেন তারা উৎসাহিত করেছে? ২০০৯-১০ সালে যখন শেয়ারবাজার চাঙা হয়েছিল, তখন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এর কৃতিত্ব নিয়েছেন।
তাহলে কেন ধসের দায় নেবেন না? ২০১০ সালে শেয়ারবাজারের ধসের কারণ অনুসন্ধানে সরকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করলেও এর সুপারিশগুলো আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সরকারের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজারে লাভ হলে নিজের, আর লোকসান হলে সরকারের দায় বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি আংশিক সত্য। পুরো সত্য হলো, তদন্ত কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও শেয়ারবাজারের কারসাজির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ শেষের উপলব্ধিটি শুরুতে জানতে পারলে হয়তো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হতেন। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তাঁর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অটুট থাকার কথা বলেছেন। কিন্তু একজন সফল অর্থমন্ত্রীকে যে কেবল প্রধানমন্ত্রীর আস্থার ওপর নির্ভর করলেই চলে না, তাঁকে দেশের লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকেও আস্থায় নিতে হয়, সেই সত্যটি তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী বাঙালির হুজুগে প্রবণতা এবং অর্থমন্ত্রী আগের সরকারের ভুল নীতিকে দায়ী করলেও নিজেদের দায়টি যথারীতি অস্বীকার করে গেছেন। দায় অস্বীকারের এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শুধু শেয়ারবাজার নয়, অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও স্থিতি ও গতি আনা কঠিন হবে।
No comments