ভর্তি-শৃঙ্খলা ফিরবে কবে

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি-প্রক্রিয়ায় এখনো শৃঙ্খলা আসেনি। সে কারণে বিভিন্নভাবে ভর্তি পরীক্ষার্থীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ক্ষতিগুলো অব্যবস্থাপনাজনিত কারণেই হয়ে থাকে। এটা দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আন্তবিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত চেষ্টা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যেসব ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেগুলো দূরীকরণে কার্যকর সিদ্ধান্ত থাকা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, তাঁদের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ যেটি হয়, তা পালনের চেষ্টা করা। প্রতিবছর সব উপাচার্য আলোচনা করে তারিখ নির্ধারণ করেন। প্রায় কোনো বছরেই এই তারিখ মেনে সব বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে না। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সকালে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে বিকেলে পরিবর্তন করেছে। যদি কোনো কারণে নির্দিষ্ট তারিখে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে অবশ্যই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা একই দিনে হয়—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। গত বছরগুলোয় একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিংবা এমন দূরত্বে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়েছে যে একটিতে অংশ নেওয়ার পর অন্যটিতে অংশ নেওয়া সম্ভব হয় না।
ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন হার নির্দিষ্ট হওয়া জরুরি। ভর্তি ফরমের মূল্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এতটাই পার্থক্য থাকে, যেটি খুবই অশোভন। ভর্তি-ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভর্তি ফরমের মূল্য ঠিক করা প্রয়োজন। কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর কোনো শিক্ষার্থী যদি ভর্তির সময়সীমার মধ্যে ভর্তি বাতিল করেন, তাহলে ভর্তির সময়ে গৃহীত সমুদয় অর্থ সেই প্রার্থীকে ফেরত দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, একজন শিক্ষার্থী হয়তো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভর্তি হলেন, পরে পরীক্ষা হওয়ার কারণেই হোক আর অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার কারণেই হোক, তিনি হয়তো তুলনামূলক ভালো কোথাও ভর্তির সুযোগ পেলেন; সেই ক্ষেত্রে তাঁর ভর্তির টাকা ফেরত পাওয়াটা তাঁর অধিকার। তিনি তো ভর্তি বাতিল করলে সেই আসনে অন্য একজন ভর্তি হবেন। একই আসনে দুজনের ভর্তির টাকা নেওয়া অযৌক্তিক। একটি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন পরিবারের শিক্ষার্থীর কাছে এটা অনেক বড় বিষয়। ভর্তি পরীক্ষা থেকে যে আয় হয়, তার ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বলে গণ্য করে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা থেকে সরকার অভ্যন্তরীণ আয় না করলে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে ভর্তি ফরমের মূল্য কম করা সম্ভব। যে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই পারলেন না,
তাঁর কাছে ফরম বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি করা অনেকটা অমানবিকও বটে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেসব ক্যাম্পাস বৈধ নয়, সেগুলো যাতে ভর্তি-প্রক্রিয়া চালাতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতখানি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, তাও নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ইচ্ছামতো যাতে সেমিস্টার বাবদ অর্থ নিতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা জরুরি। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে না হলেও কয়েকটিতে ভর্তি পরীক্ষায় সরকারের তদারকি প্রয়োজন। যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্ধারিত সময়ে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলোতে এ বছর ভর্তি বন্ধ রাখা উচিত। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় ভর্তির শর্তপূরণে ব্যর্থ শিক্ষার্থীরা যাতে ভর্তি হতে না পারেন, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের তৎপর হওয়া প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলা বিভাগ খোলা প্রসঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আমরা খুব সরব থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। তাই ভর্তির আগেই সে-বিষয়ক নির্দেশনা জরুরি। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন কোর্স বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতার সময়টা প্রার্থীদের কাছে এতটাই কঠিন যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল এবং সেখান থেকে রংপুরে তাঁদের ছুটতে হয়। কখনো কখনো ভর্তি পরীক্ষার্থীরা বাস রিজার্ভ করে ছুটতে থাকেন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁদের কষ্ট লাঘব করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইউনিটভিত্তিক অনেক দিন পর পর পরীক্ষা না নিয়ে দুই দিনের মধ্যে শেষ করা প্রয়োজন। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় একাধিক ইউনিটে পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা সময়ে ঢাকায় যেতে হয়। অথচ পরীক্ষা যদি সকাল-বিকেল ও ধারাবাহিক প্রতিদিন নেওয়া হয়, তাহলে প্রার্থীদের এক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার জন্য অর্থ ও সময় ব্যয় করে হরতালের বাংলাদেশে বারবার ছুটতে হয় না। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যাবে না, এমনটাও ঠিক নয়। পিএসসির যে পরীক্ষা হয়, তার মধ্যে বিসিএস লিখিত পরীক্ষাগুলো ছুটির দিন ছাড়াই হয়।
প্রয়োজনে অঞ্চল ধরে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন রাজশাহীতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের একজন পরীক্ষার্থীকে দুবার যেতে হয়। যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর পর পরীক্ষা হতো, তাহলে যাঁরা দূর থেকে দুবার রাজশাহীতে যান, তাঁদের দুবার যেতে হতো না। একইভাবে ঢাকায় যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হবে, সব কটিতে যদি একটির পর অন্যটি হয়, তাহলে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের অনেক সময়-অর্থ-শ্রম সাশ্রয় হবে। শিক্ষার্থীদের সময়-অর্থ-শ্রম সাশ্রয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তৎপর হলে সম্মান শ্রেণীর ভর্তি-প্রক্রিয়ায় অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। যে অব্যবস্থাপনা এ বছর দূর করা সম্ভব, তা এ বছরেই দূর করা উচিত। আর যেগুলো এ বছর সম্ভব নয়, সেগুলো আগামী বছর ভর্তি-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই দূরীকরণে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.