গণতান্ত্রিক সমাজে রক্তাক্ত বিপ্লব কি কাম্য? by ফরহাদ মজহার

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম(অব.)
ট্রটক্সি একবার বলেছিলেন, বিপ্লব দারিদ্র্যের কারণে সংঘটিত হয়। সহস্র লোক রাস্তায় নেমে তাদের পুঞ্জীভূত বেদনা প্রকাশ করলে এবং যোগ্য কাজের সন্ধান বা পাত্তা না পেলে তারা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। গুলির সামনে থেকে পালিয়ে অন্যত্র আহার-বাসস্থানের সামান্য সম্ভাবনাও যদি না থাকে, তবে তারা গুলির সামনে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হয় না। আর গুলিবর্ষণকারী একসময় হতচকিত হয়। কতজনকে আর গুলি করা যায়! তার অবচেতন মনে একসময় প্রশ্ন জাগে- কার জন্য সে গুলি ছুড়ছে? প্রশ্ন জাগে গুলি ছোড়ার যৌক্তিকতা নিয়েও। ফলে দেখা যায়, প্রশাসন একসময় হাত গুটিয়ে বসে পড়ে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথ প্রকম্পিত হওয়ার পর ঠিক এ অবস্থাই হয়েছিল। ইরানে রেজা শাহ পাহলভির সময়ে তার সিক্রেট পুলিশ দ্বারা মানুষ গুম করা শুরু হলে বিদেশ থেকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে ইরানে ব্যাপক বিদ্রোহ ও আন্দোলনের কারণ শাহের গোপন পুলিশ বাহিনীর কার্যকলাপ। আবার ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ায় সবজি বিক্রেতাদের আন্দোলন যেভাবে বিস্তৃত হয়েছিল, তাও ধারণার অতীত। অন্যদিকে আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে গড়ে তোলার নজির স্থাপিত হয়েছিল বেইজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কয়ার দখলের মধ্য দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় মিসরের তাহরির স্কয়ার ও তুরস্কের তাকসিম স্কয়ারে একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। ইরানে ১৯৭৯ সালে শাহের শাসন অবসানের লক্ষ্যে আয়াতুল্লাহ্ খোমেনির নেতৃত্বে আন্দোলনে ৪৪৮ দিনে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তাদের এ আত্মত্যাগের ফলে রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটে। ঠিক ১০ বছর পর ১৯৮৯ সালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কয়ারে ৫১ দিন ধরে অবস্থান করে ৩ হাজার মানুষ জীবনদান করলেও তাদের দুর্নীতিবিরোধী সে আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোর দুষ্টু সরকারের (ঙঢ়ঢ়ৎবংংরাব ৎবমরসব) বিরুদ্ধে ১০ দিনের অন্দোলনে আনুমানিক ১ হাজার মানুষ নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তার স্বৈরশাসনের অবসান হয়। আন্দোলন সার্থক হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০৪ সালে ইউক্রেনে ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। ২০১০ সালে তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট বেন আলীর বিরুদ্ধে ৩০ দিনের আন্দোলন ১৪৭ জন মানুষের আÍত্যাগের মধ্য দিয়ে সফল হয়। ২০১১ সালে মিসরে ১৮ দিনের আন্দোলনে প্রায় ৩০০ মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হোসনি মোবারকের শাসনাবসান ঘটে।
মানুষ সাধারণত পরিবর্তনের প্রত্যাশী। বিদ্যমান বা চলমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে (অ্যান্টি ইনকামবেন্সি) তাদের অবস্থান নেয়াটা তাই অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। মানুষ সহজেই এতে আকৃষ্ট হয় এবং ‘আমরা পরিবর্তন চাই’ বলতে পাগল হয়। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। রাজনীতি বিষয়ের পণ্ডিতরা মনে করেন, যে সরকার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে এবং কোথায় কোথায় বিদ্রোহ বা আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে তা আগেই আঁচ করতে পারে, সে সরকারের পক্ষে আন্দোলন দমন করা সহজ। এরিক সেলবিনের বই ‘রেভোল্যুশন, রিবেলিয়ন, রেজিস্ট্যান্স’ এ বক্তব্য সমর্থন করে। আগের একটি লেখায় আমি বলেছিলাম, বিপ্লব বা বিদ্রোহ একদিনে সংঘটিত হয় না। পুঞ্জীভূত বেদনা ও বঞ্চনার বিষয়গুলো যদি সহানুভূতি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখা না হয়, তাহলেই বিপদ। আর অঞ্চলে অঞ্চলে বিভেদ, নাগরিকে নাগরিকে বিভেদ এবং বিশেষ শ্রেণী বা পেশার মানুষকে অধিকতর সুযোগদান পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ী। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি হল আইনের শাসনের অভাব। এর ফলে জঙ্গলের শাসন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আশার কথা, ইদানীং শ্রীলংকায় ইমারজেন্সি সমস্যার সমাধানে, নেপালে মাওবাদীদের ক্ষমতায় আসা ও সহিংসতা পরিত্যাগে, ভুটানে জাতীয় জীবনে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসে’র প্রসারে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার মাধ্যমে এ ধরনের সহিংস ঘটনা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে সন্ত্রাসী গ্র“পগুলোর অস্ত্র পাচারের ঘটনা। উল্লেখ্য, অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা সাধারণত মাদকের বিনিময়ে ঘটে থাকে।
ভারতের পশ্চাৎপদ ও দুর্গম অঞ্চলগুলোয় নিুবর্ণদের প্রতি অবহেলা, শিক্ষা ক্ষেত্রে একঘরে করে রাখার প্রবণতা তাদের প্রতিবাদী করে তুলেছে। ভারতের ফুলন দেবী সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে এলেও সমাজ তাকে রেহাই দেয়নি। তার দুঃখজনক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতের নকশাল আন্দোলন বিলুপ্ত না হওয়া এবং অঞ্চলবিশেষে সরকারি বাহিনীর ওপর তাদের আক্রমণ সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ-সংসার ও স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে আন্দোলনকারীরা এত ভয়ংকর হবে কেন? আর আইন রক্ষাকারীরা কেন তাদের প্রতিহিংসার শিকার হবে! অধুনা বাংলাদেশে পুলিশের ওপর আক্রমণও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে । নকশাল নেতা কাটাকাম সুদর্শন আনন্দ ছত্তিশগড় নরহত্যার জন্য দায়ী। দাতেওয়াদা অঞ্চলে ৭৬ সিআরপিএফ সদস্য হত্যা করে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে- ওই অঞ্চল তাদের। ওখানে তারা অন্যের শাসন চায় না। অথচ এটা কি ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের জনপ্রিয় দাবি? কাটাকাম কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যার মাওবাদীদের প্রধান নেতা হিসেবে কটেশ্বর রাওয়ের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। কাটাকাম কত কঠিন নেতা, দায়িত্ব নেয়ার পর তা তিনি এভাবে জানান দিলেন। মিডিয়া, জনসাধারণ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজেকে পরিচিত করতে, সেই সঙ্গে তিনি যে একজন নিষ্ঠুর নেতা তা প্রকাশ করার জন্য হয়তোবা এ কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। সুদর্শন অন্ধ্রপ্রদেশের একজন মানুষ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস বলে বিশ্বাস করেন। নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক কোনো ধরনের আলোচনায় তিনি বিশ্বাসী নন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় এ অঞ্চলে মাওবাদী অন্দোলনের অবসান ঘটবে বলে যে ধারণা ছিল, তা ভুল প্রমাণিত হল।
আগে অস্ত্র পাচারের রুট নেপাল ও ভারতের রেড করিডোর হয়ে শ্রীলংকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নেপালে মাওবাদীদের নতুন উপলব্ধি এবং সরকার পরিচালনায় নতুন অভিযাত্রা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলেছে। বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে এদেশের ভূমি ব্যবহার করে অস্ত্র চোরাচালানের হার বর্তমানে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর ফলে নৃশংসতা ও গোলাগুলি কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করা যায়। এরপর থেকে যায় শুধু সুশাসন। নিজস্ব বাহিনী যদি নিজ জনগণের ওপর হিংস্র আচরণ করে, তবে তা রোধ করা অসম্ভব। সাধারণ মানুষ তখন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। আইন প্রয়োগকারীদের এজন্য ধৈর্যশীল ও নিজ জনগণের ওপর সহনশীল হওয়া অতি জরুরি। আপন দেশে যদি কেউ আপন না হয়, তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! হতদরিদ্রের এ দেশে সুশাসন, সুবিচার ও গণতন্ত্রই হতে পারে বিদ্রোহ নির্মূলের আসল ওষুধ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম, পিএসসি (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে

No comments

Powered by Blogger.