অনেক কিছুই বদলে যাওয়ার কথা ছিল- বদলায়নি by মোকাম্মেল হোসেন

আমি বসেছি বাসের একেবারে পেছনের একটা সিটে। নিয়ম অনুযায়ী এই বাসে সিটের অতিরিক্ত কোনো যাত্রী উঠানোর কথা না। এরা সেই নিয়মটা মানছে না। তাই নিয়ে সামনে বসা যাত্রীরা কন্ডাকটরের সঙ্গে হইচই করছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন রুটে আজকাল সিটিং সার্ভিসের নামে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এটাও সে ধরনেরই একটা বাস সার্ভিস। নাম নবকলি পরিবহন প্রাইভেট লিমিটেড। নামের সঙ্গে বাসের চেহারার মিল খুঁজতে গিয়ে আমার হাসি পেল। আমাকে হাসতে দেখে পাশের যাত্রী বললেন-
: ভাই, ডোন্ট মাইন্ড। কী জন্য হাসলেন জানতে পারি?
- হাসলাম দুঃখে।
: স্যরি! আমি আরও ভাবছি মজার কোনো জিনিস দেইখ্যা...
- দুঃখটা মজা থেইক্যাই উৎপন্ন হইছে।
: কীরকম!
- মালিকপক্ষ এই বাসটার নাম রাখছে নবকলি, অথচ বাইরে যেমন-তেমন, এর ভিতরের অবস্থাটা একবার দেখেন। অর্ধেক সিটই ভাঙা। এর মধ্যে কয়েকটা আবার দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখছে। কী তার নাম আর কী তার চেহারা!
: এই ধরনের জিল্লতিরে কী বলে জানেন?
- কী বলে?
: বলে- ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম।
- হাঃ হাঃ হাঃ। হানড্রেড পার্সেন্ট সত্য কথা বলছেন। আইচ্ছা, আমারে একটা কথা বলেন তো, লোকাল সার্ভিস হিসেবেও রাস্তায় চলার যোগ্য না, এইরকম লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা একটা বাস সিটিং সার্ভিসের অনুমোদন পাইল কীভাবে?
: এর উত্তর খুবই সোজা। অনুমোদনের ক্ষমতা যাদের হাতে ন্যস্ত, তারা বাসের নাট-বল্টু ঠিক আছে কিনা সেইটা লইয়া মাথা ঘামায় না! তারা শুধু দেখে, প্রতিমাসে তাদের হাতে টাকার যে বান্ডিলটা ধরাইয়া দেওয়া হয়, সেইগুলার মধ্যে ছেঁড়াফাটা কোনো নোট আছে কিনা! আপনে জানেন, কয়েকদিন আগে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটছিল?
- কী?
: এই কোম্পানির একটা বাস মহাখালী রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় হঠাৎ ঘুমাইয়া পড়ছিল। বাসের ড্রাইভার হাজার চেষ্টা কইরাও সেইটারে সজাগ করতে পারে নাই। শেষে একটা ট্রেন আইসা দুই ফাল্টা করার পর বাসটা টের পাইছে- কোনখানে সে বিছানা পাতছিল!
- বলেন কী! এই বাস নিচে গেছিল কী করতে? এইটার তো ফ্লাইওভারের উপর দিয়া চলাচল করার কথা।
: নিচে দিয়া গেছিল যাত্রী টুকাইতে।
- কেউ আহত-নিহত হয় নাই?
- ধুসমুস কইরা নাইম্যা যাওয়ায় কোনো যাত্রী আহত-নিহত হওয়ার চান্স পায় নাই। তবে আশপাশে থাকা জনাছয়েক পথচারী ও দোকানদার আহত হইছে। শুনছি, তাদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর...
নবকলির শুধু চেহারাই খারাপ না, চরিত্রও খারাপ। কারও চরিত্রে দোষ থাকলে দশজন দশরকম কথা বলার সুযোগ পায়। এর বেলায়ও তাই ঘটল। কন্ডাকটরের উদ্দেশে একজনকে বলতে শুনলাম-
: অই হারামজাদা, এইটা সিটিং সার্ভিস, না চিটিং সার্ভিস?
লোকটার কথা শুনে কন্ডাকটর সরু চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল-
: গালি দেন ক্যা!
পাশ থেকে অন্য একজন বলে উঠল-
: গালি তো তর জন্য কম হইয়া যায়। তর পাছায় কইষ্যা একটা লাত্থি দেওন দরকার।
- দেন লাত্থি!
ভদ্রলোক উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন-
: লাত্থি দিলে কী করবি তুই?
- আগে দিয়া দেখেন না!
ভদ্রলোক জামার হাতা গুটিয়ে প্রস্তুতি নিলেন। তারপর উচ্চস্বরে বললেন-
: অই ফকিন্নির পুত! তরে কি আমার শনি-মঙ্গলবার দেইখ্যা তারপর লাত্থি দেওন লাগব ভাবছস?
- আমি ফকিন্নির পুত- ঠিক আছে! কিন্তু আপনে জমিদারের পুত হইয়া বাসে উঠছেন ক্যান? প্রাইভেট কারে চলাফেরা করতে পারেন না!
: আমি কিসে চলাফেরা করব এইটা তুই বলার কে? এমন চড় দিব- বাড়িতে যাওয়ার পর তর বৌ তর মুখে কোনো দাঁত খুঁইজ্যা পাবে না।
- এইটা পারবেন! একবার লাত্থি মারবেন- একবার চড় মারবেন! তবে ওস্তাদের মাইর শেষরাইতে। মাইর-গুতা যাই দেন- আমরা একবার ধরলে কিন্তু আর ছাড়ি না। বৈশাখীর ভুইল্যা গেছেন?
পাশে বসা সেই ভদ্রলোক ফিসফিস করে আমার কাছে জানতে চাইলেন-
: বৈশাখ মাসে কী ঘটছিল?
বৈশাখী পরিবহনের ঘটনাটা আমি জানি। বিষণœকণ্ঠে বললাম-
: বৈশাখ মাস না, ও বলছে সাভার থেইক্যা গুলশান-নতুনবাজার রুটে চলাচলকারী বৈশাখী পরিবহনের কথা। ওই বাসে একদিন এইরকম কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের মারামারি লাইগ্যা যায়। এর জের ধইরা পরিবহন শ্রমিকরা ৭ জন বাসযাত্রীকে পিটাইয়া মাইরা ফেলছিল।
: আরে! এ তো সাংঘাতিক লোক! খুন করার কথা কেমন বুক ফুলাইয়া বলতেছে দেখছেন!
- সাংঘাতিকের দেখছেন কী! এই ব্যাটা তো এখন অন্যদের খুনের গল্প শুনাইতেছে। দুইদিন পরে নিজেই মানুষ খুন করার কারবারে নাইম্যা পড়বে।
: কীভাবে!
- নিজেরে ড্রাইভার ঘোষণা করার মাধ্যমে।
: বলেন কী!
- জ্বি।
ভদ্রলোক আমার দিকে স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর কন্ডাকটরের দিকে ইশারা করে বললেন-
: এই লোক টাকা গুনতে-গুনতে ড্রাইভার হইয়া যাবে! ড্রাইভার হওয়ার জন্য মৌলিক কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়বে না?
- না, পড়বে না। রাস্তায় গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়ার আগে তারে শুধু জিজ্ঞাসা করা হবে-
: তুমি গরু চেন?
- জ্বে স্যার, চিনি।
: বল তো, গরুর কয়টা মাথা?
- মাথা তো স্যার আপনের মতো একটাই!
: গুড। কয়টা লেজ?
- লেজও স্যার একটাই।
: ভেরিগুড। তুমি তো দেখতেছি হেভি ট্যালেন্ট। আইচ্ছা, এইবার বল- ছাগলের কয়টা চোখ?
- দুইটা।
: কয়টা ঠ্যাং?
- চাইরটা।
: ওয়েলডান। যাও, সমগ্র বাংলাদেশের যে কোনো রোডে গাড়ি চালাইতে তোমার আর কোনো বাধা নাই...
আমার কথা ও অভিনয় দেখে ভদ্রলোক মজা পেয়ে হো হো করে উঠলেন। হাসতেই হাসতেই বললেন-
: বাস্তবে সত্যি সত্যি এইরকম হয় নাকি?
- হয় না মানে? আপনে পরিসংখ্যানের দিকে তাকান। পরিসংখ্যান বলছে- সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেইক্যা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হইল দ্বিতীয়। এর কারণ কী জানেন? এর কারণ হইল এই দেশে এইভাবে ড্রাইভার হওয়া যায় বইল্যা। দেশে এইরকম ড্রাইভারের সংখ্যা কম কইরা হইলেও ৭ লাখ। আমাদের দেশে সড়কপথে প্রতিবছর অন্তত ৫ হাজার দুর্ঘটনা সংঘটিত হইতেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় কমপক্ষে ৪ হাজার মানুষ ও পঙ্গুত্ব বরণ করে এর দ্বিগুণ। যদি আপনে এর আর্থিক ক্ষতি পরিমাপ করেন তাইলে তা টাকার অংকে দাঁড়ায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া সড়কপথে সংঘটিত প্রতিটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারাজীবনের অপূরণীয় বেদনা ও আর্থিক সংকটে নিপতিত হওয়ার কারণ হওয়ায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী ভাড়া কম দেয়ার সূত্র ধরে বাসের পরিবেশ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। এ কথা সে কথা বলার পর কন্ডাকটর তাকে বলল-
: ধুনপুন না কইরা ৩২ টাকা ভাড়া দেন।
- কোন দুঃখে ৩২ টাকা দিব?
: ভাড়া ৩২ টাকা।
- শ্যামলী থেইক্যা শেওড়া পর্যন্ত ৩২ টাকা ভাড়া নেওয়ার পারমিশন তরে কে দিছে?
: এইটা সিটিং সার্ভিস।
- অই চিটার, তর এই বাস সিটিং সার্ভিস হইলে আমি দাঁড়াইয়া রইছি কীজন্য?
: আমি কি আপনেরে জোর কইরা উঠাইছি? আপনে নিজের ইচ্ছায় উঠছেন।
- দরজা খোলা পাইছি, তাই উঠছি। দরজা বন্ধ থাকলে উঠতাম?
: ক্যাচাল কইরেন না তো! ভাড়া দেন।
- ভাড়া তো দিছি।
: আরও দেওন লাগব।
- অসম্ভব। তুই আমার হাতে তেল ধরাইয়া দিয়া বলবি- ঘিয়ের দাম দেন, এইটা তো হইতে পারে না! যেমন দই, তেমন পয়সা।
শেওড়া পৌঁছার পর সেই যাত্রী বাস থেকে নামার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই কন্ডাকটর তাকে আটকাল। যাত্রী ভদ্রলোক ক্ষেপে গিয়ে বললেন-
: তুই আমার হাত ধরছস ক্যান?
- আগে টাকা দেন, তারপর নামেন।
: টাকা না দিলে কী করবি? বাস থেইক্যা নামতে দিবি না? আয়, সাহস থাকলে আটকা।
ভদ্রলোক কন্ডাকটরকে ধাক্কা দিয়ে বাসের দরজার কাছে যেতেই সে চিৎকার করে ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল-
: ওস্তাদ, গাড়ি টান দেন। আবদুল্লাহপুরের আগে গাড়ি বেরেক হবে না।
ড্রাইভার গাড়ির গিয়ার বদল করতেই সেই যাত্রী লাফ দিয়ে ড্রাইভারের পাশে দাঁড়াল। তারপর ড্রাইভারের গালে একটা চড় মেরে বলল-
: এই- গাড়ি থামা।
চড় খেয়ে ড্রাইভার কয়েক সেকেন্ড থ মেরে তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো একবার ডানে একবার বামে বাস ঘোরাতে লাগল। শেওড়ার পরের স্টপেজ বিশ্বরোড। আমার এখানেই নামার কথা। কুড়িল ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর বিশ্বরোডের এ জায়গাটায় এখন যানবাহনের ভিড় অনেকটাই কমে গেছে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ড্রাইভার বাসের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
: সবগুলারে খালে ডুবাইয়া মারমু...
ড্রাইভারের কাণ্ড দেখে বাসের মহিলা ও শিশুরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল। বাসটা যখন খিলক্ষেত স্টপেজেও থামল না, তখন যাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের আতংক দেখা দিল। আমি অবাক হয়ে ড্রাইভারের কারবার দেখছিলাম আর মাত্র কিছুদিন আগে পাস হওয়া একটা আইনের কথা ভাবছিলাম। সে আইনে বলা হয়েছে- দুর্ঘটনায় যানবাহনের যাত্রী মারা গেলে কোনো ড্রাইভারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা যাবে না। এ মুহূর্তে এ বাসের ড্রাইভার সব যাত্রীকে রাস্তার পাশের খালে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। ড্রাইভার যদি সত্যি সত্যি এ কাজ করে, তারপরও তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা যাবে না! কী ভয়াবহ ব্যাপার!
সবাই মিলে অনেক অনুরোধ আর অনুনয় করার পর শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরের সামনে এসে ড্রাইভার বাস দাঁড় করাল। আমাকে এখন রাস্তার ওপাশে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা একটা বাস ধরে বিশ্বরোড যেতে হবে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটওভার ব্রিজে উঠে দাঁড়ালাম। কোথাও শৃঙ্খলা নেই। যতদূর চোখ যায়- এলোমেলো-বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা। দৃশ্যপটটা এরকম হওয়ার কথা ছিল না। দিন বদলের প্রতিশ্র“তি দিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। শাসক দলের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী অনেক কিছুই বদলে যাওয়ার কথা ছিল- বদলায়নি। অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল- পাওয়া যায়নি। আমি ঝাপসা চোখে হিসাবের খাতাটার দিকে তাকালাম। দেখলাম- সেখানে একটা গুবরেপোকা হামাগুড়ি দিচ্ছে...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.