এমন ঘটনা আর কখনও যেন না ঘটে by ড. সুকোমল বড়ুয়া

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩। এ দিনটি গত বছর ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ট্রাজেডির ভয়াল সেই রাতের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। বৌদ্ধ পুরাতত্ত্ব ও ঐতিহ্যের অন্যতম তীর্থভূমি পর্যটন নগরী কক্সবাজারের রামু, যেখানে শত শত বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য, স্থাপত্য ও নানা ভাস্কর্য-সংস্কৃতি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেখানেই ঘটে গিয়েছিল স্মরণাতীতকালের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপর্যয়ের এক কালো থাবা। আমাদের প্রিয় রম্যভূমি রামু সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল জনপদ- যেটি আরাকান সংলগ্ন প্রাচীন ব্রহ্মদেশীয় সব থেরবাদী আদর্শকে ধারণ করে এসেছে। কিন্তু সেই ঐতিহ্যের তীর্থস্থানের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডাই শুধু নয়; রাস্তার পাশে মন্দির ও বিহারের পার্শ্ববর্তী অনেক স্থাপনা ও বসতবাড়ি সেদিন রাতে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। শুধু রামুর কেন্দ্রীয় সীমা বিহার নয়, খুবই নামকরা প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার লালচিং ও সাদাচিং এবং উত্তর মিঠাছড়ির শত ফুট দীর্ঘ সিংহশয্যা শায়িত বুদ্ধমূর্তিই নয়, উখিয়ার দীপাংকুর বিহার, জেতবন বিহার ও আর্যবংশ প্রভৃতি ২২টি বৌদ্ধ বিহার এবং চট্টগ্রামের পটিয়ার লাখেরা ও কোলাগাঁও সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহার, টেকনাফের হোয়াইক্যাং ও রামু-উখিয়ার ৪০টিরও বেশি বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দু’শতাধিক রৌপ্য ও স্বর্ণের মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি লুটপাট হয়ে যায়। প্রাচীন পুঁথিপুস্তক, পাণ্ডুলিপি ও ভিক্ষুসংঘের মূল্যবান ব্যবহার্য জিনিসপত্র এবং অনেক ধাতব দ্রব্য জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। এসব ঐতিহ্য দেশ-বিদেশের গবেষকদের বৌদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানের মূল্যবান উপাদান ছিল। আগামীতে হয়তোবা অনেক নতুন জিনিস পাওয়া যাবে, কিন্তু এসব দুর্লভ গবেষণা ঐতিহ্যের উপাদান আর কোনো দিন পাওয়া যাবে না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর এ যেন স্মরণকালের ইতিহাসের এক ভয়ানক বর্বরোচিত হামলা। এ হামলাকে কেউ মেনে নিতে পারেনি, আগামীতেও পারবে না।
সবাই বলছে, এটা এদেশের বৌদ্ধদের ওপর বৌদ্ধ স্থাপনা ও ঐতিহ্যের ওপর চরম আঘাত। অন্তত মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া কয়েকশ’ বছরের ইতিহাসে বৌদ্ধদের ওপর এ রকম সাম্প্রদায়িক আঘাত আর কখনো আসেনি। তাই বলতে দ্বিধা নেই যে, সেদিনের সেই ধংধ্বযজ্ঞের ভয়ানক দৃশ্য এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে এক বিরাট আঘাত হেনেছে। সেদিন আমরা আমাদের হাজার বছরের ধর্ম ও সংস্কৃতির এক অনুপম ঐতিহ্যকে হারিয়েছি। আমাদের মনে হয়েছে, এ যেন বিশ্ব মানবতার এক করুণ বিপর্যয়। তাই আজ দিনটিকে গভীর হৃদয় দিয়ে, আর অন্তরের শোক ও সহানুভূতি দিয়ে স্মরণ করছি। সেদিন এ নৃশংস বর্বরতায় যাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে; ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে, তাদের প্রতি জানাই গভীর সহানুভূতি। আর যারা গৃহহারা হয়ে বহু কষ্টে বাইরে ছিল, তাদের প্রতি জানাই গভীর মমত্ববোধ ও সমবেদনা।  আমরা বিশ্বের যেখানেই যাই না কেন, সেখানে গর্ব করে বলি ‘বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’। এ যেন আমাদের শত সহস্র বছরের সম্প্রীতির ঐতিহ্য। এ দেশে জন্মগ্রহণ করে আমরা ধন্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ছিল তাই। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রধান এ চারটি ধর্ম ছাড়াও রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুুদ্র নানা জাতিগোষ্ঠী ও নৃ-সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। আর বৌদ্ধদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাতত্ত্ব তো এ দেশের মাটির গভীরে পরতে পরতে মিশে আছে। এমন একটি সামাজিক বন্ধন, সবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানে, আর সাম্যের ভিত্তিতে যে দেশ গড়ার প্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, তা যেন সেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সে যেন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে।
মহামতি বুদ্ধ কোনো ধর্মের প্রতিপক্ষ নন। তিনি এক মহামানবতার প্রতীক, অহিংস ও সাম্যের প্রতীক। আর বৌদ্ধরাও কোনো ধর্মগোষ্ঠীর কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষ নন। তাহলে কেন সেদিন বৌদ্ধদের ওপর এ আঘাত হানা হয়েছিল? কী দোষ ছিল তাদের? ফেসবুকে সাজানো কোরআন অবমাননাকর একটি মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ রকম আঘাত আসতে পারে না। সবাই জানে, বৌদ্ধরা অতি নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায়। এদেশে বৌদ্ধদের ওপর এ রকম আঘাত কারও কাম্য ছিল না। দেশ-বিদেশে বৌদ্ধদের অনেক সুনাম ও মর্যাদা আছে বেশ উঁচুতে। সে জন্যই তো সেদিন এ ঘটনায় বিশ্ববিবেক জেগে উঠেছিল। দেশজুড়ে মানবতার ঝড় বয়েছিল। এহেন জঘন্য কাজ যারা করেছে, তাদের ঘৃণা ও নিন্দা জানিয়েছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকেও নিন্দা জানিয়েছে তারা তাদের দায়িত্ব রক্ষা করতে পারেনি বলে। সে এক সহমর্মিতার অপূর্ব নিদর্শন যেখানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, সব শ্রেণী-পেশার মানুষ জড়ো হয়ে সভা-মিছিল করেছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে। গোটা দেশ বৌদ্ধদের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। সেদিন আমাদের মনে হয়েছে, আমরা যেন আবার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে ফিরে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে যেমন কোনো ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ছিল না, বৈষম্য ছিল না- ঠিক সে রকম মনে হয়েছে আমাদের এই একাত্মতার মধ্যে।
এ সন্ত্রাসী হামলায় জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা, ডব্লিউএফবিসহ দেশ-বিদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানও ধিক্কার জানিয়েছেন। দেশের সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণের ধিক্কার তো ছিলই। সরকারও বিব্রতবোধ ও বেশ চাপে ছিল। সেদিন সরকার বলুন, আর প্রশাসনই বলুন, আমরা কেউ এ সম্প্রীতি বিনষ্টের লজ্জা ঢাকতে পারিনি, পারবও না। কারণ দেশ-বিদেশের কূটনৈতিক মিশনসহ সারাবিশ্বের চোখ ছিল আমাদের প্রতি নিবদ্ধ। সেদিন সবার প্রশ্ন ছিল সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতা দেখেও জাতি সেদিন স্তম্ভিত হয়েছে। এখনো সে প্রশ্ন বারবার উঠে আসে। ঘটনার খুব কাছাকাছি থেকেও কেন তারা অগ্রসর হয়নি, কেন দেখে ও জেনে-শুনে আইন রক্ষাকারী সংস্থা ও প্রশাসন দায়িত্ব পালন করেনি সেটাই জনগণের প্রশ্ন। অতি নিকটে ছিল রামু থানা, উপজেলা নির্বাহী অফিস, চার-পাঁচশ’ গজ দূরে ছিল সেনা ক্যাম্প, বর্ডার সিকিউরিটি গার্ডসহ সরকারের আইন-শৃংখলা ও স্থানীয় প্রশাসন এবং ৭-৮ কিলোমিটার দূরে ছিল জেলার হেডকোয়ার্টারগুলো। ঘটনার আগে ও পরে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাও ছিল যেন নীরব। এ প্রশ্ন শুধু স্থানীয় বৌদ্ধদের নয়, আন্তর্জাতিক মহলসহ দেশ-বিদেশের সব মহলের, তদন্ত সংস্থারও।
খুবই দুঃখের বিষয় যে, সেদিন জনতার মিছিলে আরও দেখা গেছে সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাদের। এ তথ্য বারবার পত্রপত্রিকায় এসেছে। এমনকি থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গে মিশে উস্কে দিয়ে সে সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। সবার ধারণা, এটা পূর্বপরিকল্পিত। সেখানকার প্রশাসনের সম্পৃক্ততা ছাড়া এহেন নাশকতামূলক কাজ সম্পাদন করা কারও পক্ষে কখনো সম্ভবপর নয়। এখনো সেই জঘন্য কর্মকাণ্ডের কোনো সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা হয়নি। স্থানীয় জনগণ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নিরীহদের নিয়ে থানায় মামলা হয়েছে, এখনো হয়রানি চলছে। অথচ প্রকৃত দোষীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা প্রতিদিন সরকারদলীয় নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে, বক্তব্য দিচ্ছে। ৩ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন নতুন করে নির্মিত বিহার উদ্বোধন করেন, সে সময়ও তারা নাকি মঞ্চের আশপাশে ছিল।
সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভস্মীভূত সেই বৌদ্ধ বিহারগুলো দৃষ্টিনন্দন করে পুনঃনির্মাণ করে দেয়ার জন্য। এ জন্য সেনাসদস্যরা রাত-দিন খেটেছেন। আসলে তাদের দায়িত্বেই বিহারগুলো পুনঃনির্মিত হয়েছে। তারা বেশ শ্রম দিয়েছেন। কাজে যতœবানও ছিলেন। তাদেরও জানাই ধন্যবাদ। কিন্তু আজ এ শোকাবহ দিনে একটি প্রশ্ন- ভস্মীভূত প্রাচীন ঐতিহ্যের ওপর সুন্দর ও সৌকর্যমণ্ডিত বৌদ্ধ বিহার তৈরি করা হয়েছে, আগুনে পুড়ে যাওয়া গৃহহীনের ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে, তারপরও কি ‘মধুপূর্ণিমা’ রাতের সেই আগুনের ভয়াল দৃশ্য ও সন্ত্রাসীদের বীভৎস তাণ্ডবতা সেখানকার শিশু-কিশোর, ভিক্ষু-শ্রমণ, যুবক-যুবতী, আবালবৃদ্ধবনিতা কখনো ভুলতে পারবে? আরও প্রশ্ন, সেদিন বৌদ্ধদের হৃদয়ে যে আঘাত ও ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কি কখনো ভোলা যাবে, কখনো পুনঃনির্মাণ করা যাবে? তাই এমন ঘটনা আর কখনো যেন না ঘটে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার

No comments

Powered by Blogger.