বেবি মানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় by মোকাম্মেল হোসেন

ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের আঁচ লাগতেই পেছন ফিরে দেখি লবণ বেগম চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল। লবণ বেগমের চোখের তারায় প্রস্ফুটিত প্রশ্নের বিপরীতে আমিও আমার চোখ জোড়ায় প্রশ্নের আলপনা আঁকার চেষ্টা করলাম। তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হল না দেখে জিজ্ঞেস করলাম-
: কী হইছে!
- বেবি কে?
বেবি একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হচ্ছে শিশু। অনেকের নামও বেবি রাখা হয়। লবণ বেগমের জিজ্ঞাসার ধরন শুনে মনে হল, শেষোক্তটিকে ঘিরেই তার প্রশ্ন আবর্তিত হচ্ছে। বিস্মিত হয়ে বললাম-
: বেবি কে- মানে!
- অত মানে-মানে করতেছ কেন? তুমি জান না- বেবি কে?
: না, জানি না!
- না জানলে বেবির কাছে তোমার কী কাজ?
: বেবির কাছে আমার কাজ মানে?
- কিছুক্ষণ আগে ফোন কইরা তুমি বেবির কাছে যাওয়ার কথা বল নাই?
এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পারলাম। এ বেবি মানে হল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আজ আমার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ভিসি বেসরকারি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন। তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। এ বিষয়ে সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলার সময় মজা করে বেবি-বেবি করছিলাম। লবণ বেগম এ বেবিকে রক্ত-মাংসের কোনো রমণী মনে করায় আমি হো-হো শব্দে হেসে উঠলাম। আমাকে হাসতে দেখে লবণ বেগম কঠিন গলায় বলল-
- হাসতেছ কেন? আমি হাসির কিছু বলি নাই।
: অবশ্যই বলছ! তুমি যারে লইয়া সন্দেহ পোষণ করতেছ- সে কোনো মানবী না। আমি বেবি বলতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বুঝাইছি। আজ আমার সেইখানে যাওয়ার কথা।
- সেইখানে তোমার কী কাজ?
: একজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করব।
- কার?
: ভিসির।
ধানমণ্ডির ২৭ নম্বরে অবস্থিত সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর দারোয়ান পথরোধ করল। বলল-
: স্যার, জুতা খুইল্যা যান।
- কেন?
: জুতা পায়ে দিয়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ।
- কে নিষেধ দিছে?
: স্যারেরা।
- অই মিয়া, ফাইজলামি পাইছ? এইটা কী কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় যে, পায়ের জুতা বগলে লইয়া এর ভেতরে যাওন লাগব?
- আপনেরে জুতা বগলে লইতে বলি নাই; বাক্সে রাইখ্যা যাইতে বলছি।
: আমি জুতা বাক্সে রাখতে যাব কোন দুঃখে!
- এইটাই নিয়ম।
এসময় একজন ভদ্রলোক সেখানে উপস্থিত হতেই দারোয়ান সিনা টান করে তাকে স্যালুট জানাল। ভদ্রলোককে জুতা পায়ে গটগট করে ভেতরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে দারোয়ানকে বললাম-
: উনারে জুতা রাইখ্যা যাইতে বললা না কেন?
- উনি আমাদের স্যার।
: যে নিয়ম তোমার স্যারেরা মানে না- সেইটা অন্যদের ওপর চাপাইছে কীজন্য?
- এইটা আমি কেমনে বলব! আমি হইলাম হুকুমের দাস। যেইভাবে তারা হুকুম দেয়- আমি সেইভাবে ডিউটি পালন করি...
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭১। এরই একটির মধ্যবয়স্ক এক দারোয়ান যখন জুতা নিয়ে আমাকে নিয়মের নামতা শেখাচ্ছিল, ঠিক তখনই সেখানে একটা অনিয়মের ঘটনা ঘটল। এটাকে আমি উদাহরণ বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু তারপরও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই- নিয়মের আড়ালে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ংকর সব অনিয়ম আর অনাচার চলছে। মালিকানা দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তে পাঠদান, কোচিং সেন্টারের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, ভাড়ায় শিক্ষক এনে জোড়াতালির ক্যাম্পাস পরিচালনা, সনদ বিক্রি, ক্যাম্পাস ও শাখা বিক্রিসহ এমনসব কীর্তিকলাপ সেখানে চলছে- যা এক কথায় ভয়াবহ। কিছুদিন আগে ফুটপাতে চা পান করতে গিয়ে এদের একটা কীর্তির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী চায়ের দোকানের পাশে আড্ডা দিচ্ছিল। এসময় একজনকে বলতে শুনলাম-
: ফ্রেন্ড, আমি তো চিপায় পইড়া গেলাম।
- কেন, কী হইছে!
: গত মাসে বেতন পেমেন্ট করতে পারি নাই। আইজ সেইটা দিতে যাওয়ার পর বলল- বকেয়া বেতনের বিপরীতে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ প্রদানসহ তা পরিশোধ করতে হবে...
শিক্ষাগুরু সক্রেটিস থেকে শুরু করে নিকট-অতীতের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত জ্ঞান বিতরণের কাজকে ঐশ্বরিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের হাওয়ায় সে দৃশ্যপট আমূল পাল্টে গেছে। জ্ঞান বিতরণের কাজ এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং সেন্টার ইত্যাদির পর শিক্ষা-বাণিজ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা এক-একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে প্যাকেজ আওতায় জাতিকে জ্ঞান বিতরণের মহৎ কাজটি করে চলেছেন। জ্ঞানার্জনের উপায়, পদ্ধতি ও পরিবেশ যাই হোক না কেন, ট্যাকে যথেষ্ট পরিমাণ ‘কড়ি’ না থাকলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব অর্জন করা যায় না। অনেকেই কোচিং সেন্টারের আদলে বহুতল ভবনের একটি বা দুটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্যের পসরা খুলে বসেছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মানে হাজার-বারশ’ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট কয়েকটি ক্লাসরুম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা অনেক ব্যাপক। নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, পাঠাগার ও গবেষণাগারসহ সমন্বিত পাঠদানের জন্য আনুষঙ্গিক সবকিছুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা প্রয়োজন। এখানকার শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় যেমন পারদর্শী হয়ে উঠবে, তেমনি সবুজ ক্যাম্পাসের শিশিরভেজা ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ফুল-পাখি-প্রজাপতি চিনবে। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখছি? বিপণিবিতান, বাসস্ট্যান্ড, আবাসিক এলাকা, এমনকি শিল্প-কারখানার আশপাশের ভবনে গড়ে ওঠা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় না আছে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, না আছে জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ। দামি কার্পেট যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীছাত্রীদের জুতা খুলে ভেতরে যাওয়ার নিয়ম করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিদার এসব প্রতিষ্ঠান চটকদার বিজ্ঞাপন আর নানা কৌশলের আড়ালে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে গলা কাটা ফি আদায় করে কার্পেট কালচারে মোড়ানো যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাতে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। শ্যামলী আশা ইউনিভার্সিটির পাশে সম্প্রতি একটি নতুন মার্কেট উদ্বোধন করা হয়েছে। পঙ্গুসহ অন্যান্য হাসপাতালের পাশে হওয়ায় মার্কেটের অধিকাংশ দোকানপাট ওষুধ ও সার্জিকেল যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত। কিছু দোকান এখনও ভাড়া হয়নি। টু-লেট ঝুলছে। একদিন একটা কাজে মার্কেটের ভেতরে গিয়ে দেখি- একটা দোকানের সাটারের ওপর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম লেখা। কৌতূহল হওয়ায় সেখানকার একজনকে জিজ্ঞেস করলাম-
: ভাই, এইটা কী!
লোকটা আমার দিকে সরু চোখে তাকাল। আমি এটাকে কোনো মঘা দাওয়াখানা বা হারবাল সেন্টার ভেবেছি মনে করে সে তাচ্ছিল্যমাখা ভঙ্গিতে আমাকে বারকয়েক পরিমাপ করার পর গম্ভীর কণ্ঠে বলল-
: এটা একটা ইউনিভার্সিটি।
পনের বাই বিশ ফুটের একটা রুম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রাবাসের একটি টাট্টিখানার যে আয়তন, এটা তার চেয়েও ছোট। অথচ এটাকে ইউনিভার্সিটি বলা হচ্ছে। হায়! দুঃখ রাখি কোথায়! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃংখল অবস্থা দূর করার জন্য অভিভাবক হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন রয়েছে। দেশের আর দশটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে সেভাবে না চলে সেজন্য তাদের অনেক কিছু করার কথা। কিন্তু অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার প্রশ্নে এ দুই কর্তৃপক্ষ দুই সাইডে চলে যায়। স্বার্থ হাসিলের জন্য একপক্ষ যেটাকে বেঠিক বলে, অন্যপক্ষ সেটাকে সঠিক হিসেবে ঘোষণা দেয়। দু’পক্ষের ঠিক-বেঠিকের ডামাডোলে অনিয়ম-অনাচার ও স্বেচ্ছাচারের সীমা অতিক্রম কতটা অতিক্রম করেছে তা বুঝতে পারলাম পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: বর্তমানে কী করতেছ?
- একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করতেছি।
তার কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। বললাম-
: মাস্টারি করতেছ মানে? তুমি তো অনার্সে থার্ডক্লাস পাইছ!
- এইটা কোনো ব্যাপার না!
: বুঝলাম না!
- আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তো! তাই আমার জন্য এইটা কোনো সমস্যাই না।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.