তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগণতান্ত্রিক নয় by ড. শরীফ মজুমদার

কিছু পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী সরকার সমর্থকদেরই একটি বড় অংশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে। তবুও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অগণতান্ত্রিক বলে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায়, কেউ ইচ্ছা করলেই একটি দাবিকে ‘গণতান্ত্রিক’ বা ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত করতে পারেন কি-না? সম্ভবত পারেন, কারণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই ৪-৫ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তাহলে গত ৪-৫ বছরে এমন কী পরিবর্তন হয়েছে যে, একটি ‘গণতান্ত্রিক’ দাবি ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত হচ্ছে?
মুখ্য পরিবর্তনটি হল, একটি বিতর্কিত বিষয়ে সমগ্র জাতি আজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই কয়েক বছর আগে যখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন, তখন জাতি আজকের মতো এতটা বিভক্ত ছিল না। দ্বিধাবিভক্ত দেশে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা লোপ পায়? একটি অবুঝ শিশুও বলবে ‘না’; বরং প্রয়োজনীয়তা আরও প্রকটভাবে অনুভূত হয়। অন্য আর কী পরিবর্তন হয়েছে, যাতে করে জনগণ ধরে নিতে পারে গণতান্ত্রিক পন্থায় জাতি অনেক এগিয়ে গেছে? কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি হয়েছে। কিন্তু সেই নির্বাচন কমিশনের প্রধানই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। সুতরাং কিভাবে একটি গণতান্ত্রিক দাবি কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অগণতান্ত্রিক হয়ে যাবে, তা বোধগম্য নয়।
গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তির ইচ্ছায় গণতান্ত্রিক দাবি অগণতান্ত্রিকে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত; এটি শুধু স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্ভব। যে দাবিগুলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে উপস্থাপন করেছিলেন, তার অধিকাংশই আজও প্রযোজ্য। সুতরাং বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত পূর্ববর্তী বিরোধীদলীয় নেত্রীর দাবির প্রতিই অনুসমর্থন বৈকি। এটি তৃতীয় বিশ্বের শাসনব্যবস্থার একটি ধরন- যেখানে ক্ষমতাসীন দল সব সময় মনে করে, তাদের শাসনামলে গণতান্ত্রিক চর্চায় এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে আগের মতো অরাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতা হল, বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ সরকারের মনে করার সঙ্গে কখনোই একমত হতে পারে না। তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের প্রয়োজন ফুরাবে তখনই, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা জন্ম নেবে এবং সেক্ষেত্রে দেশের বিচার বিভাগের করণীয় খুবই সীমিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনও সেই আস্থার জায়গাটি থেকে অনেক দূরে। এ থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তা একবারের প্রয়াসে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
তৃতীয় বিশ্বে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন পরিচালনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর নির্বাচন-পূর্ব দায়িত্বগুলো অনেকাংশে নির্বাচনকালীন দায়িত্বের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি রাজনৈতিক দল ৫ বছর ধরে তাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ধরে নিয়ে দেশ পরিচালনা করে, তখন তাদের মধ্যে স্বভাবতই এ ধারণা জন্ময় যে সবকিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব হল এটি নিশ্চিত করা যে, সবকিছু গণতন্ত্রের ধারণা অনুযায়ী চলবে, ক্ষমতাসীনদের পছন্দ অনুযায়ী নয়। সে হিসেবে অবশ্যই আমাদের বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতান্ত্রিক। এটি গণতান্ত্রিক বলেই তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখন উন্নত বিশ্বের দেশগুলো হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না এবং এর কারণ গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। এ শ্রদ্ধাবোধের কারণেই সেখানে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। মূলত রাজনীতিকদের এ অক্ষমতাই সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ টিকিয়ে রাখে। আর তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে এ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশটি ফিরিয়ে আনাই হল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ। কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জনগণ ও বিরোধী দলের আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে, এমনটা বোধগম্য নয়। এ আস্থাহীনতাই নির্বাচন-পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার জন্ম দেবে এবং সে কারণেই আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এমন অনেক ঘটনাই আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটেছে যেগুলোর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না, কিন্তু সেগুলো আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক বলে অনুভূত হয়েছিল। পরে আমরা সেগুলোকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করিনি বরং সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধান ধর্মগ্রন্থ নয় যে এতে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। সংবিধান গণতান্ত্রিক বিষয়গুলোকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে থাকে মাত্র। সুতরাং সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকেও গণতান্ত্রিক আইনগত স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যতক্ষণ না সব রাজনৈতিক দল কোনো চাপ ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ব্যতিরেকে নির্বাচনে অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। উন্নত দেশের নির্বাচন পদ্ধতির উদাহরণ দেয়া তখনই মানাবে, যখন তাদের অন্য গণতান্ত্রিক চর্চাগুলোও উদাহরণ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন উন্নত দেশগুলোতে নগ্ন রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং রাজনৈতিক হানাহানি কোনো নির্বাচনকালীন ঘটনা নয়। ভোটের আগে নগদ টাকা লেনদেনের মতো বিষয় তারা চিন্তাও করতে পারে না; ফলে আর্থিকভাবে শক্ত অবস্থানে থাকা সরকারি দল ও নাজুক অবস্থানে থাকা বিরোধী দল নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনক হল, এ বিষয়গুলো তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাচনকালীন সময় সবসময়ই মুখ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হল, উন্নত দেশগুলোতে সরকারি দল নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে এ কারণে যে, বিরোধী দল নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না; যদি বিরোধী দল প্রশ্ন তুলত, তাহলে সরকারি দল নিজে থেকেই এ ধরনের বিতর্কিত কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখত। এটা তাদের একে অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরই বহিঃপ্রকাশ। এ সম্মান প্রদর্শন একের প্রতি অন্যের আস্থা থেকে আসে, যা সবকিছুরই নিয়ামক। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আগে সেই আস্থার পরিবেশটি সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যখন উন্নত দেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেন, তিনি এ বিষয়গুলো আড়াল করে যান।
উন্নত দেশগুলোতে জাতীয় বিতর্কিত বিষয়গুলো বিচারবিভাগের মাধ্যমে সুরাহা না করে গণভোটের মাধ্যমে সুরাহার জন্য জনগণের ওপরই ছেড়ে দেয়া হয়। গণভোটের দিক থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, সীমিতভাবে হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর ‘গণভোট’ কিছুটা হয়েই গেছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে অন্দোলনেরই ফলস্বরূপ। সুতরাং এটি সীমিতভাবে হলেও জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনর্বহালের পক্ষে গণরায়। এখন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আলোচনা করতে চাইলেও জনগণের ভোট ভিক্ষুক হিসেবে তা আর করতে পারছে না। কারণ তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি সমর্থকরা এটিকে তাদের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে দেখবে। এটি স্বাভাবিক, কারণ গত ২-৩ বছরে যে দাবিটি বিরোধী দলকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা রেখেছিল তা হল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং প্রকারান্তরে এ দাবিই একটি মজবুত বিরোধী মোর্চার সৃষ্টি করেছিল, যা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল তৈরি করেছে। এ মোর্চা বিএনপির একার মোর্চা নয়; সুতরাং বিএনপি একা ইচ্ছা করলেই আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো আলোচনায় অংশ নিতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দলই তা করতে পারে না; কারণ তাদের বিপুল সমর্থকের সেন্টিমেন্টের প্রতি সম্মান দেখাতে হয়। বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগও যখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল, তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। সুতরাং পূর্ববর্তী বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্য যেমন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ছিল, তেমনি বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার জন্যও তা গণতান্ত্রিকই রয়েছে। এ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক বলেই এটি জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এটি গণতান্ত্রিক, তাই এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের প্রতি সম্মান রেখেছে, যে ইশতেহার দেখে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। সে ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কোনো অঙ্গীকার কোনো রাজনৈতিক দলই করেনি। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দাবি করতে হলে সে দাবি এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে এনে তার পক্ষে জনগণের সমর্থন আদায় করে পরে দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে।
পরিশেষে একটি প্রবাদের কথা মনে করিয়ে দেই- ‘মহানুভবতা নিজেকে দিয়েই শুরু করতে হয়’। যেহেতু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনুরূপ পরিস্থিতিতে নিজেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার দাবি করছিলেন, সুতরাং তিনি বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার দাবির প্রতি সম্মান দেখাতে নৈতিকভাবে বাধ্য। আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়কহীন নির্বাচন দাবি করা কিছুটা অকালপক্বতারই শামিল। কেউ যদি জোরপূর্বক তা করতে চান, তাহলে হয়তো অবশেষে সামরিক ক্ষমতা দখলকেই গণতান্ত্রিক বলে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং দুঃখজনক সত্য হল, সে ধরনের কোনো অধ্যায়ের সূচনা হলে তা স্বাভাবিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার যে পদ্ধতি, সে পদ্ধতিটিকেই শ্লথ করে দেবে। সব শেষে যে মন্তব্যটি করব তা হল, উন্নত দেশের নির্বাচন পদ্ধতিকে উদাহরণ হিসেবে আনার আগে সে দেশগুলোতে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বিরোধী দলের যে আস্থা থাকে সে উদাহরণটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ এ আস্থার জায়গাটি তৈরি হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এমনিতেই আর কোনো বাধা থাকবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে বিরোধী দলের সম্মতি আদায় করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোন দেশ কিভাবে নির্বাচন করছে তা নয়।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.