উচ্চ মাধ্যমিকের ফল এবং আমাদের রাজনীতি by মাছুম বিল্লাহ

২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে আসছিল এইচএসসির পাসের হার। কিন্তু এ বছর সাধারণ ৮টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার গতবারের চেয়ে ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমে যাওয়ায় বিভিন্ন মহল এর কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজ্ঞান বিভাগের রসায়ন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছে। ভালোভাবে না বুঝেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, রাজনৈতিক অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ৩২টি পরীক্ষা পেছাতে হয়েছিল। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি কাউকেই রেহাই দেয় না। লক্ষণীয়, আমাদের রাজনীতিকদের রাজনীতি থেমে নেই এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও। তারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য। তবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় যে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই এবং এজন্য যে শুধু বিরোধী দল দায়ী তাও নয়। আবার সরকারি দল যখন বিরোধী দলে ছিল তখন যদি তারা এমন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারত যে, তারা হরতাল করে জনগণকে বিপাকে ফেলেনি, তাহলে সরকারি দল আজ বিরোধী দলকে এভাবে কথা বলতে পারত। আবার বিরোধী দল যে ভূমিকা রেখেছে, তাও সমালোচনার বাইরে নয়। আমাদের বুঝতে বাকি নেই যে, কোনো দলই ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা খুব একটা চিন্তা করে না। তারা চিন্তা করেন ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া নিয়ে। দেশের জন্য রাজনীতি করলে বিরোধী দল আর সরকারি দল যারাই হোক, জাতির জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা একই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কি তা হচ্ছে? সরকারে থাকাকালীন জনগণের জন্য চিৎকার করব আর বিরোধী দলে গেলে জনগণ ভোট দেয়নি এজন্য তাদের ওপর প্রতিশোধ নেব- তাদের এ ভূমিকা তো সবার কাছেই স্পষ্ট। জনগণ বলির পাঁঠা, শিক্ষার্থীরা তা থেকে বাদ যাবে কেন?
এবার পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ১ এপ্রিল, শেষ হয়েছে ২৩ জুন। হরতালের কারণে ৯ দিন নতুন করে পরীক্ষা নিতে হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অংশে আংশিক হরতালের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষা ঝুঁকির মধ্যে নিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম বোর্ডের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা হরতালের কারণে চারবার পেছাতে হয়েছে। বিরোধী দলের জন্য নয়, সরকারের ব্যর্থতার কারণে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়ার সমালোচনা করে বিশ্লেষক ও বিরোধী রাজনীতিকরা বলছেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পরীক্ষা পদ্ধতি অপরিচিত ছিল, তাই ফলাফল ভালো হয়নি। সরকারের ভুল শিক্ষানীতির কারণে ফল বিপর্যয় হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, বিরোধী দল কি এ দায় এড়াতে পারে?
প্রায় প্রতিবছরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে নটর ডেম কলেজ- ১ হাজার ৭৬৬ জন। তবে সেরা কলেজ নির্ধারণে ৫টি মানদণ্ড থাকায় সেরাদের তালিকায় গতবারের মতো প্রথম হয়েছে রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ। নটর ডেম হয়েছে ৬ষ্ঠ, গতবার ছিল ৫ম। দ্বিতীয়বারের মতো সেরাদের তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছে নরসিংদীর আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তারপর যথাক্রমে রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ, ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ, নটর ডেম কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, হলিক্রস কলেজ ও দশম অবস্থানে ঢাকা কলেজ। অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হল, সেরা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানদণ্ড নির্ধারণে কিছুটা পরিবর্তন আনা। শুধু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বা জিপিএ-৫ পাওয়াই সেরা প্রতিষ্ঠান হওয়ার শর্ত হতে পারে না। কতজন শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে ভর্তি হল এবং কতজন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করল ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এবার পাসের হার এবং জিপিএ-৫-এর সংখ্যা কমার পাশাপাশি শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। গতবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৬। এবার এ সংখ্যা ৮৪৯। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবার ছিল ২৪, এবার এ সংখ্যা ২৫।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা এক ধরনের যুদ্ধ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া আরেক ধরনের যুদ্ধ। তবে এবার উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ভর্তিতে কোনো আসন সংকট হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গত বছরের তুলনায় জিপিএ-৫ প্রায় তিন হাজার কম হলেও পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। গত বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দশ বোর্ড থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিল মোট ৬১ হাজার ১৬২ জন, এবার পেয়েছে ৫৮ হাজার ১৯৭ জন। আর এবার এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯১ জন এবং গত বছর পাস করেছিল ৭ লাখ ২১ হাজার ৯৭৯ জন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে মেধাবীরা এবার বেশি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। গতবারের চেয়ে ২৩ হাজার শিক্ষার্থী বেশি উত্তীর্ণ হলেও এ বছর উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে আসন সংখ্যাও বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ইউজিসি ও ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবার ভর্তিযোগ্য আসন হচ্ছে ৫০ হাজার। এর মধ্যে এক হাজারের ওপর আসন আছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার, বুয়েটের এক হাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রায় তিন হাজার, জাহাঙ্গীরনগরে প্রায় তিন হাজার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন হাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন হাজার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক হাজার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হাজার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় হাজার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজার আসন আছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা বাড়ানো সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
এবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫শ’। যেখানে ২ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও আসন খালি থাকবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান বলেন, এবার ডিগ্রি পাস কোর্সেও ভর্তি হয়েছে ৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। আগামী বছরও এই সুযোগ থাকছে। এছাড়া লেদার টেকনোলজিতে আসন আছে প্রায় ৪শ’। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেড়ে যাওয়ায় ভর্তির সুযোগ এখানেও বেড়েছে। সরকার অনুমোদিত ৭১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার এক লাখের বেশি আসন আছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনের কোনো সীমানা নেই। যত শিক্ষার্থী তত আসন সংকুলান করা সম্ভব। এছাড়া ২২টি সরকারি মেডিকেল, ৫৩টি বেসরকারি মেডিকেল ও ৯টি ডেন্টাল কলেজে এবার আসন আছে সাড়ে ৮ হাজার। ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে আছে বেশ কিছু আসন। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে আসন সংখ্যা নিয়ে এবার উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের খুব একটা চিন্তিত হতে হবে না বা দেশের বাইরে ভর্তি হওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এটি একটি ভালো দিক। এদিকে একই ধরনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মতো ক্লাস্টার বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এবার হচ্ছে না। ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। কারণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের বিড়ম্বনা, অর্থ ও সময়ের অপচয়। এটি যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করা উচিত।
এই রেজাল্টই কি আসল রেজাল্ট? প্রতিটি কলেজে যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, সবাই কিন্তু এই পাবলিক পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায় না। কলেজেই টেস্ট পরীক্ষার মাধ্যমে অনেককে ছাঁটাই করে পরীক্ষায় পাঠানো হয়। তারপরও পাসের এই হার। যেসব শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না, তাদের দায়-দায়িত্ব কে নেবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, শিক্ষার্থী না দেশ? আমরা কেউ কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না। বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার উপযুক্ত সময় এখনই। সবশেষে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে তারা পরীক্ষা দিয়েছে। দেশের বিরাজমান রাজনীতি থেকে তাদের শিক্ষা নিতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তারা কি দুষ্ট রাজনীতির শিকার হবে, নাকি যে রাজনীতি দেশের মঙ্গল আনবে সেই দিকে পা বাড়াবে?
মাছুম বিল্লাহ : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেল্টা)

No comments

Powered by Blogger.