স্যার, সামনে ঈদ, জামিন দেন by পলাশ কুমার রায়

অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারাধীন মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে অথবা গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে তার নিযুক্ত আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন চাইতে পারেন। আগাম জামিনের ব্যবস্থাও রয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারাধীন মামলার যে কোনো পর্যায়েই জামিন চাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে তার নিযুক্ত আইনজীবী কর্তৃক আদালতে উপস্থাপিত জামিনের দরখাস্ত শুনানি অন্তে আদালত জামিন মঞ্জুর করতেও পারেন, নাও পারেন- এটা আদালতের এখতিয়ার। আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর (ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ক্ষেত্র বিশেষে জিআরও কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা) বক্তব্য শ্রবণান্তে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করলে আইনি নিয়মনীতি অনুসরণ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পাবেন। আদালত জামিন মঞ্জুর না করলে নিু আদালতের আদেশে সংক্ষুব্ধ (অভিযুক্ত) ব্যক্তি উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য আবার দরখাস্ত করতে পারেন।
আদালতে বছরজুড়েই চলে জামিন দেয়া-নেয়ার প্রক্রিয়া। তবে ঈদের আগে জেলে বন্দি অথবা আত্মসমর্পণপূর্বক অভিযুক্তের পক্ষে জামিন চাওয়ার প্রতিযোগিতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অভিযুক্তের পক্ষে তার নিযুক্ত আইনজীবী ঈদের আনন্দ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভোগ করার সুযোগদানের জন্য যে কোনো শর্তে জামিনের দরখাস্ত করে থাকেন। ঈদের আগে প্রায় প্রত্যেক আইনজীবীই অভিযুক্তের জামিন চাওয়ার সময় বলেন, স্যার, সামনে ঈদ যে কোনো শর্তে জামিন দেন। ঈদের আগে এভাবে জামিন চাওয়া একটা প্রথায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের আবেগাপ্লুুত আবেদন অনেক সময় আদালত সংশ্লিষ্ট অনেকের হƒদয়কে স্পর্শ করে বলে আইনজীবীদের চিকন গলার আওয়াজে এ প্রক্রিয়ায় জামিন চাওয়ার কৌশল কাজেও লাগে হয়তো!
এ প্রসঙ্গে একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলায় অভিযুক্তদের জামিন শুনানির সময় উচ্চ আদালতে পুলিশের কোনো প্রতিনিধি থাকেন না। তাই গাড়ি চুরি, অপহরণ, ডাকাতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আদালতের নজরে আনার সুযোগ হয় না। উচ্চ আদালতে যদি পুলিশের প্রতিনিধি রাখা সম্ভব হতো, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিযোগের বর্ণনা তুলে ধরে জামিনের ঘোর বিরোধিতা করা যেত। উচ্চ আদালতে এ কাজটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় দেখভাল করে। মামলার আধিক্য অথবা সময় স্বল্পতায় প্রস্তুতি নিতে না পারার কারণে হয়তো অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তারা (সহকারী/ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) প্রতিটি চাঞ্চল্যকর মামলায় অভিযুক্তদের জামিনের বিরোধিতা করতে পারেন না বলে অভিযুক্তরা উচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে মুক্তি পান। এমনকি যারা নিু আদালতে আত্মস্বীকৃত খুনি অথবা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তারাও জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, জামিনে মুক্তি পেয়েই অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলার অভিযোগকারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অন্যথায় ওই পরিবারের অপর কোনো সদস্যকে খুন অথবা অন্য কোনো গুরুতর ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে বসে। সাক্ষীকেও আদালতে দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয়ার জন্য হুমকি-ধামকি দেয়। এভাবে মামলার অভিযোগকারী ও সাক্ষী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে আপস-মীমাংসা বা ভবিষ্যতে বড় ধরনের ক্ষতির আশংকা থেকে রক্ষার জন্য অভিযোগকারী নিজে থেকে মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তবে একথাও সত্যি, সব অভিযুক্ত ব্যক্তিই জামিনে মুক্তি পেয়ে অভিযোগকারী কিংবা সাক্ষীকে ভয়ভীতি, হুমকি-ধামকি দেয় না। অনেক সময় অভিযোগকারী মামলায় সাময়িক সুবিধা এবং অভিযুক্তের জামিন বাতিলের জন্য কাছের থানায় সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়ে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। এতে হয়তো বিচারাধীন মামলায় পরবর্তী ধার্য তারিখে অভিযুক্তের জামিন বাতিল করে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন। এতে ন্যায়বিচার ও জামিনে মুক্ত থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নির্দোষ ও নিরপরাধ অভিযুক্তরা। আবার এমন ঘটনাও মাঝেমধ্যে শোনা যায় যে, তুচ্ছ বা কাল্পনিক কোনো ঘটনায় জেলে বন্দি নিরপরাধ অভিযুক্তরা আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে বছরের পর বছর ধরে জেলের ঘানি টানছে। ঈদের আগে জামিন নিয়ে অনেক রসালো খবর শোনা যায়। একশ্রেণীর দালাল অভিযুক্তের জামিন করিয়ে দেয়ার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। আত্মীয়স্বজন ও অভিভাবকরা জেলে বন্দি স্বজনের সঙ্গে ঈদের দিন একত্রে উপভোগ করার জন্য দালাল চক্রের চাহিদা মতো টাকা দিতেও কার্পণ্য করেন না। এভাবে আদালতপাড়ার প্রতারক দালাল চক্র এবং তাদের সহযোগী কতিপয় আইনজীবী, আদালতপাড়ায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা, আদালতে কর্মরত স্টাফসহ অনেকেই সহজ সরল বিচারপ্রার্থীদের নয়ছয় বুঝিয়ে ঈদ মৌসুমের জামিনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিচারপ্রার্থীদের আত্মীয়স্বজনের বিভ্রান্ত করার কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এসবের মূল উদ্দেশ্য আটক অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের কাছে যেনতেনভাবে ফুসলিয়ে জামিন পাইয়ে দেয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা আদায় করা।
আদালতে কর্মরত অনেকেই মনে করেন, অন্য সময়ের তুলনায় ঈদের আগে প্রায় দ্বিগুণ অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করা হয়। ঈদের অজুহাত ও নানা ধরনের আবেদনময়ী বক্তব্যে আইনজীবীরা আদালতের দয়া ও করুণা চেয়ে অভিযুক্তের জামিন প্রার্থনা করেন। অনেকের জামিন হয়ও। ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি, খুনি, ধর্ষক, অপহরণকারীর জামিন মঞ্জুর করাতে বড় বড় আইনজীবীর অভাব নেই। কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল অভিযুক্তদের (বিচারপ্রার্থীদের) কী হবে? তারা আর কতদিন অর্থাভাবে উকিল সাহেব ধরতে না পারার কারণে জেলে বসে পচবে? তাদের আÍীয়স্বজন জানেন না, ঈদের আগে ঈদের অজুহাতেও জামিন পাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকে। আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ার কারণে বছরের পর বছর, হয়তো যুগের পর যুগ তাদের উঁচু দেয়াল বেষ্টিত জেলখানায় বসে হালুয়া-রুটি-সেমাই আর এক বাটি মাংস খেয়েই ঈদের দিনটি কাটাতে হবে। পরিবার-সমাজ থেকে অনেক দূরে থাকা এসব বন্দির ঈদের দিনটি কেমন কাটে- আমাদের মাননীয় আইনমন্ত্রী তার খোঁজ রাখেন কি? বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলোও এ ব্যাপারে তৎপর নয় কেন?
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী; আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)

No comments

Powered by Blogger.