পরীক্ষার ফলাফল ও সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কথা by বিমল সরকার

সৃজনশীল পদ্ধতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন সংযোজন। উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান স্তরে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে এবং মাধ্যমিক স্তরে আরও আগে থেকেই দেশে এ পদ্ধতিটি চালু হয়। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার সময় থেকেই সচেতন মহলে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও লক্ষ্য করা যায়। ৩ আগস্ট এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে আবার নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। প্রশ্ন উঠেছে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকদের দক্ষতা নিয়েও। বর্তমান সরকার আসার পর প্রথম ৪ বছরে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এবার সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে এসে পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের ক্রমবর্ধমান গতিটি বাধাগ্রস্ত হয়। কেউ কেউ এটাকে ফলাফল বিপর্যয় বলে অভিহিত করেছেন। যদিও এরকম ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এসএসসি, এইচএসসি বা ডিগ্রির মতো এক-একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং এসবের ফলাফল নিয়ে আমরা বড় দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্য অনেক কিছুর মতো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে। সদ্য স্বাধীন দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা এবং শত বাধাবিপত্তি ও অব্যবস্থার মাঝে বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এক-একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই পরীক্ষাগুলোতে হয় ব্যাপক হারে গণটোকাটুকি। পাসের হার উঠে দাঁড়ায় ডিগ্রিতে ৬৫ বা ৭০ শতাংশ এবং এসএসসি বা এইচএসসিতে ৮০, ৯০, এমনকি ৯৮ শতাংশ। কিন্তু কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অর্জিত সর্বকালের সর্বোচ্চ এই পাসের হার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ক্রমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতা এবং বাধা-বিপত্তিগুলো কমে আসায় শিক্ষা ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে থাকে। ফলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই অনুষ্ঠিত এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার নেমে আসে ২৮, ৩০ বা ৩২ শতাংশে এবং ডিগ্রিতে ৬, ৭ কিংবা ৯ শতাংশে। গোটা আশির দশকই কাটে বলতে গেলে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতার মাঝ দিয়ে। বিএনপি সরকারের আমলে এবং আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে নতুন করে অনিয়ম, অব্যবস্থা ও নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হয়। এ সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যাপক গোলযোগ, গণটোকাটুকি, এমনকি পরীক্ষা কেন্দ্রে গুলি ছোড়ার মতো ঘটনাও সংঘটিত হয়েছে। কোনো বিষয়ের একটিমাত্র পত্রের পরীক্ষায় ৫ হাজার, ১০ হাজার করে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত মোট ৩০ বা ৪০ হাজারের মতো পরীক্ষার্থী বহিষ্কার করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। বহিষ্কার ছাড়াও প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাদানে বিরত থাকে আরও মোট ২০-২৫ হাজার কিংবা এরও বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার ও বিরত থাকা পরীক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ৫০, ৬০ এমনকি ৭০ হাজারও ছাড়িয়ে যায় কখনও কখনও। মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষা চলাকালে ব্যাপক হারে নকল করায় একটি কেন্দ্রের মোট ১৬০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম দিনই চার শতাধিক পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার ঘটনাও অনেকের মনে থাকার কথা। ভুলে যাওয়ার কথা নয় এক-একটি বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ৩০, ৪০ কিংবা ৬০-৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনও পাস না করার স্মৃতি। এভাবে নব্বইয়ের দশকের শেষ ও দশের দশকের শুরুর দিকে এক-একটি পরীক্ষায় পাসের হার ২০, ২৫ কিংবা ৩০-৩২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
এখন আমরা অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছি। গত ৫-৬ বছর ধরে বহিষ্কার ও বিরত থাকা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে কমে গেছে। পাসের হার ৬০, ৭০ ও ৮০-র ঘরে সামান্য ওঠানামা করে। এমন পরিস্থিতিতে এইচএসসি পরীক্ষায় গত বছরের তুলনায় ৩-৪ ভাগ কম পাস করা কিংবা ৫০-৬০ হাজার জিপিএ-৫ এর স্থলে ২-৩ হাজার কমে যাওয়াকে ‘কিছুটা খারাপ’ বলা গেলেও আর যাই হোক কোনোক্রমেই ‘ফলাফল বিপর্যয়’ বলা যাবে না।
এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা উপর্যুপরি হরতালকে প্রধানত দায়ী করে বক্তব্য রেখেছেন। আবার বিএনপি ও জামায়াত নেতারা পাল্টা বলেছেন, হরতাল নয়, সরকারের অদক্ষতা ও অনুসৃত শিক্ষানীতিই ফলাফল খারাপের মূল কারণ। এদিকে ফলাফল নিয়ে ফেল করা এবং কাক্সিক্ষত ফলাফল থেকে বঞ্চিত দাবিদার পাস করা পরীক্ষার্থীদের মাঝে হতাশা, অসন্তোষ ও ক্ষোভের অন্ত নেই। এসব পরীক্ষার্থী তাদের ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবং দেশের আরও কয়েকটি স্থানে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়ার কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে। বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা অবশ্য ফলাফল খারাপের জন্য বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে হরতাল নয়, তড়িঘড়ি করে উত্তরপত্র মূল্যায়নকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তবে ফলাফল খারাপের জন্য রাজনীতি ও পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতির বাইরে থেকে নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে বলা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে যদি এখন থেকেই আন্তরিকভাবে না ভাবা হয় তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে আগামীতে সবাইকে খুবই ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করতে হবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে কেবল বাংলা বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। পরে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে বাংলা ছাড়াও রসায়ন, পৌরনীতি, ব্যবসায়নীতি ও প্রয়োগ এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে সৃজনশীল পদ্ধতির আওতা বাড়িয়ে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, সমাজকল্যাণ, হিসাববিজ্ঞানসহ আরও কয়েকটি বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক শিক্ষক এ পদ্ধতি সম্পর্কে রয়েছেন একেবারেই অন্ধকারে। প্রশিক্ষণ তো দূরের কথা, এ বিষয়ে নেই অনেকের ন্যূনতম ধারণা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ অনুসরণ করে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করে যাচ্ছেন! কেবল পাঠদানই নয়, একই সঙ্গে তারা অভ্যন্তরীণ সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্রও মূল্যায়ন করছেন! এ নিয়ে যে বিপত্তি ঘটছে না, তা কিন্তু নয়। একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষায় পৌরনীতি বিষয়ের ২৪৮টি উত্তরপত্র বিভাগের দু’জন শিক্ষক মূল্যায়ন করলেন। তাদের মধ্যে একজন ১২৪টি উত্তরপত্রের মধ্যে ১০১টিতে পাস নম্বর দিলেন আর ফেল নম্বর পেল বাকি ২৩ জন। অপর শিক্ষক ১২৪টি উত্তরপত্রের মধ্যে পাস নম্বর দিলেন মাত্র ২২ জনকে। বাকি ১০২ জনই তার দেয়া নম্বরে ফেল করেছেন। এটি কোনো সাজানো গল্প নয়, ‘সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন ও মূল্যায়ন’ শীর্ষক তিনদিনের প্রশিক্ষণ পাওয়া ও প্রশিক্ষণ না পাওয়া দু’জন কলেজ শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতার পার্থক্যের দৃষ্টান্তমাত্র।
এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা কিছুটা ব্যক্ত করি। ইতিহাস বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হচ্ছে- খবরটি জানার পর থেকে আমার মাঝে কৌতূহল ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে মনে নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জাগে। বিভিন্ন কলেজে কর্মরত কাছের এবং পরিচিত সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললে তারা সবাই আমাকে আশ্বস্ত করেন এবং জানান, প্রশিক্ষণ নিলে সবকিছুই সহজ মনে হবে। শুরু হল প্রশিক্ষণের জন্য ডাকার অপেক্ষা করার পালা। কিন্তু অনেকের ডাক পড়লেও আমার আর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় না। এ ব্যাপারে অন্যান্য বিষয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকর্মীদের সাহায্য নিয়ে কিছুটা বুঝে আর কিছুটা না বুঝে প্রথম ও পরে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করি। এ নিয়ে গ্লানিবোধ ও বিড়ম্বনার মাত্রা বাড়তে থাকে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থী এবং বাইরে সহকর্মী, এমনকি অধ্যক্ষের কাছে অসংখ্যবার আমার সীমাবদ্ধতা ও বিড়ম্বনার কথা ব্যক্ত করি। অনেক ভাবনার পর ‘সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে তামাশা!’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখি, যা ২০১২ সালের ১ নভেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত হয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে আমার বিষয়সহ বিষয়ভিত্তিক বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষককে তিনদিনের প্রশিক্ষণের জন্য ময়মনসিংহে ডাকা হয়। কিন্তু সর্বশেষ ব্যাচেও আমার নাম নেই জানতে পেরে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। কারণ বিগত ৯টি মাস ধরে সৃজনশীল পদ্ধতির নামে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের কী পড়িয়েছি জানি না। অধ্যক্ষ এবং এক বন্ধুর সহযোগিতায় আমার কলেজের একই বিষয়ের অন্য একজন সহকর্মীসহ নাম তালিকাভুক্ত করাতে সক্ষম হই। যথারীতি প্রশিক্ষণ নিই। আমার কাছে মনে হয়েছে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজটি সহজ নয়। তবে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও চর্চার মাধ্যমে তা সহজ হয়ে উঠতে পারে। এ কাজে তিনদিনের প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত তো নয়ই, বরং তা শিক্ষকদের কৌতূহল ও প্রশ্ন আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার বাকি আর মাত্র ৭ মাস। তখন অনেক বিষয়েরই পরীক্ষা হবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে। সারাদেশে কোন কোন বিষয়ের মোট কয়জন শিক্ষক এখনও প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছেন, এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে কি-না জানি না। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর আর যাতে কেউ বলার সুযোগ না পায় যে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকরা অদক্ষ- সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর আছে কি?
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.