আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি by ড. মাহবুব উল্লাহ্

পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর রাজনৈতিক আকাশে ঘূর্ণিঝড় উঠবে বলে অনেকেই আশংকা করেছিলেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঈদের ছুটির শেষ প্রান্তে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকায় এ আশংকা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু বাস্তবতা হল, এটা ছিল জামায়াতের একক কর্মসূচি। এর প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা অন্য কোনো দল সমর্থন জানায়নি। ঈদুল ফিতরের পরপরই রাজনীতি প্রবল সংঘাতময় হয়ে উঠবে বলে আমার মনে হয়নি। এ ব্যাপারে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে আমি আমার মত ব্যক্ত করেছিলাম। আমাদের মতো দেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন হুট করে দানা বাঁধে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় পূর্বপ্রস্তুতি এবং ব্যাপক জনমত গঠন। এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ব্যাপক জনগ্রাহ্যতা পেয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার জনমত জরিপেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। তারপরও কথা থেকে যায়। জনগণ যা শ্রেয় ও কাম্য মনে করেন, তার জন্য তারা যে কোনো সময় তাদের দাবি উচ্চকিত করতে রাজপথে নেমে আসেন। এর জন্য প্রয়োজন হয় মানসিক প্রস্তুতি এবং আঘাত হানার সঠিক সময়টি নির্ধারণ। সময় আসার আগে আঘাত হানতে গেলে সেটি রাজনৈতিক অ্যাডভেঞ্চারিজমে পরিণত হয়। ফল হয় ব্যর্থতা। আবার অন্যদিকে আঘাত হানতে বিলম্ব করলে সেটি হয়ে যায় রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। সে ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা অনিবার্য। এ কারণে রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য সঠিক সময় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য প্রয়োজন হয় তীক্ষœ বিচার-বুদ্ধি। বিএনপি গত সাড়ে ৪ বছরে হরতালের মতো কিছু কর্মসূচি দিয়েছে। হরতালে দোকানপাট বন্ধ থাকলেও এবং গাড়ি-ঘোড়া প্রায় না চললেও ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়নি। জনসমর্থন ও জনসহানুভূতি এক কথা, কিন্তু জনসম্পৃক্ততা ভিন্ন কথা। জনসম্পৃক্ত আন্দোলনে শুধু দলের সক্রিয় কর্মীরাই নয়, ব্যাপক গণমানুষও মাঠে নেমে আসে। আন্দোলন-সংগ্রামে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে ব্যাপক গণসম্পৃক্ততা ঘটেছিল বলেই ওইসব আন্দোলনে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। তুলনামূলক বিচারে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পূর্ব উল্লিখিত আন্দোলনগুলোর মতো ব্যাপক গণসম্পৃক্ততা ঘটেনি। তারপরও আন্দোলন সফল হয়েছিল। এরশাদের পতন হয়েছিল। কারণ এরশাদের ক্ষমতার মূল ভিত্তি সামরিক বাহিনী তার প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
এসব অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি এ মুহূর্তে কোনো সংঘাতধর্মী আন্দোলনে যাচ্ছে না। তারা জনসংযোগ ও জনমত গঠনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। মানুষের ভেতরকার সুপ্ত সমর্থনকে জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে এ জনসংযোগ ও জনমত গঠনের মূল লক্ষ্য। তারা এই ধারা ঈদুল আজহার পরও অব্যাহত রাখবে। তবে তাদের জন্য সময় খুব একটা হাতে নেই। কারণ আসন্ন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিল পাস না হলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান চালু করার সুযোগ নাও থাকতে পারে। অবশ্য সংসদ ভেঙে না দেয়া হলে সেই সুযোগ আরও কিছুকাল থাকবে। অনেকের ধারণা, অক্টোবরেই সংসদ ভেঙে দেয়া হতে পারে। আবার অনেকে মনে করেন, এ কাজটি করার জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী প্রয়োজন হবে। যাই হোক, বিএনপি এ মুহূর্তে নিঃশ্বাস ফেলার যতটুকু সুযোগ পেয়েছে সেটাকে তারা জনমত গঠন ও সক্রিয়করণের কাজে ব্যবহার করতে চায়। একটি কথা আছে, লোহা যখন উত্তপ্ত হয়ে লাল টকটকে হয়ে ওঠে তখনই আঘাত হানতে হয়। সম্ভবত বিএনপি এমন একটি অবস্থার জন্যই অপেক্ষা করছে। এতে হয়তো খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে তাদের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতে পারে। তবে বাস্তবে কী ঘটবে, সেটা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। এমনকি যুদ্ধমান বিএনপি ও আওয়ামী লীগও বলতে পারেনি।
বিএনপি গত কিছুদিন ধরে সংলাপের কথা বলে আসছে। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান ব্যাপক জনগণের আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন। বারবার সংলাপের আওয়াজ তুলে বিএনপি প্রমাণ করতে চাইছে, তারা অকারণে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায় না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন তিনি সংবিধান থেকে একচুলও নড়বেন না, ব্যাস। তার এই বক্তব্যের দু’রকম মানে করা যা। একটি হল, সংবিধান এখন যেভাবে লিপিবদ্ধ আছে তার থেকে একচুলও না নড়া। আবার একটু কল্পনাবিলাসী হলে বলতে হয়, জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধন করলে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন করলে সেটাও হবে সংবিধান থেকে একচুলও না নড়া। তবে অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ধরে নিয়েছেন, তিনি বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা থেকে একচুলও নড়বেন না। এ কারণে বিরোধীদলীয় নেত্রী তার দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের সমাবেশে কিছুটা বিদ্রুপের ছলে বলেছেন, ‘একচুল তো দূরের কথা, আন্দোলনের এমন বাতাস বইবে যে, সব চুল এলোমেলো হয়ে যাবে। এমনকি অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে।’ কথার পিঠে এমন কথা ওঠা আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। যেটুকু কথা হয়েছে সেটাকে বিদ্রুপের হুল ফুটানোর অতিরিক্ত কিছু বলা যাবে না। কেউ কেউ এমন বাক্যবাণ নিক্ষেপকে চুলাচুলি বলতেও আড়ষ্টবোধ করেননি। আসলে এরকম মন্তব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে ও জটিল করে তোলে।
বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বিগ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কিছু অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চান। জাতিসংঘের তৎপরতাও আমরা লক্ষ্য করছি। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বসংস্থাটি কত উদ্বিগ্ন! জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের একটি প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। সম্ভবত এ কারণে জাতিসংঘ নিজেকে স্টেকহোল্ডার বলে গণ্য করে। চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুনও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। চৈনিক কূটনীতি বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের কূটনীতির মতো নয়। বিশ্বায়নজনিত রেওয়াজ সত্ত্বেও চীনারা পারতপক্ষে অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করতে চায় না বা নাক গলায় না। কনফুসীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই চীনের কূটনৈতিক আচরণ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ যাত্রা চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের ব্যাপারে মুখ খোলার পর ব্যাপারটিকে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত বলে মনে হয়। সরকারকে ঘটনাপ্রবাহের এসব বাঁক-পরিবর্তনের দিকেও নজর রাখতে হবে। অন্যথায় সরকারের আচরণ দায়িত্বহীন বলে প্রতীয়মান হবে। একমাত্র প্রতিবেশী ভারতের বাংলাদেশ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি এ মুহূর্তে অন্যরকম বলে বোধ হয়। ভারতীয় মিডিয়াতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ক্ষমতা থেকে বিদায়কে ভারতের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের এই ভিন্ন অবস্থান বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারত বাংলাদেশের সন্নিকটবর্তী প্রতিবেশী। ভারত একটি বৃহৎ শক্তিও বটে। সুতরাং ভারত তার জাতীয় স্বার্থে অন্য রাষ্ট্রগুলোকে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইবে। যাই হোক, বিএনপি এ মুহূর্তের শান্তিপূর্ণ অবস্থাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো যাতে কাজে লাগাতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। বিএনপি যদি এখনই বড় ধরনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত রাষ্ট্রগুলো তাদের কাম্য ভূমিকা পালনে অস্বস্তি ও অসুবিধা বোধ করত। বিএনপির এই মুহূর্তের কৌশল হল, দেশের ভেতরে ও বাইরের জনমতকে নিজের পক্ষে আরও অনুকূল করে তোলা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুনকে জানিয়েছেন, আগামী সংসদ অধিবেশনে বিরোধীয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সংসদের অধিবেশন যেভাবে পরিচালিত হয় সেখানে এ ধরনের বিরোধীয় বিষয় নিয়ে গঠনমূলক কিছু হওয়া সম্ভব নয়। শুধু কথার পিঠে কথাই হবে। তিক্ততা বাড়বে। এছাড়া সমস্যার ফয়সালা করতে হলে সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকারি দলকেই বিল আনতে হবে। কারণ সরকারি দলেরই রয়েছে বিল পাস করার মতো নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিলটি কী হবে সে ব্যাপারে সরকারি দল ও বিরোধী দল আলাপ-আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। এটি হতে হবে একান্ত আলোচনার মাধ্যমে। উভয় পক্ষ বিভিন্ন ফর্মুলা দিতে পারে। এমনকি দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও তাদের পরামর্শ দিতে পারেন। এর ফলে উভয় পক্ষের জন্যই ফর্মুলা বাছাই করার চৌহদ্দি অনেক বিস্তৃত হবে। আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে কোনো একটি ফর্মুলা উভয়ের জন্যই সম্মানজনক সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এদিকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের কথা বলেছেন। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে অনেক কথা বললেও দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এই প্রথম তিনি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে মুখ খুললেন। মিসরের নোবেলজয়ী এল বারাদি যদি তার দেশের বিষয়ে কথা বলতে পারেন কিংবা ইরানের শিরিন এবাদি যদি তার দেশ নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন, তাহলে ড. ইউনূস কেন পারবেন না? তিনিও তো এ দেশেরই একজন নাগরিক। তার ১৬ আনা নাগরিক অধিকার রয়েছে দেশ সম্পর্কে কথা বলার। ড. ইউনূসের বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দারুণ উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এর ফলে সহনশীলতার অভাবই পরিলক্ষিত হয়েছে। ড. কামাল হোসেন বলতে চেয়েছেন, ‘যিনি রেফারি তিনিই আবার খেলোয়াড়, এটা কেমন কথা?’
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ব্যবস্থাধীনে হবে সে ব্যাপারে একটা সহমতের ধারা গড়ে উঠছে। এটি একটি শুভ লক্ষণ। এর ফলে রক্তপাত পরিহারের সম্ভাবনা জোরদার হচ্ছে। সবার যদি সুমতি হয়, যদি এটি রক্তপাতহীন সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়, তাহলে তা হবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড় পাওয়া। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.