আলোচনা-সমালোচনায় তারেক রহমান by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

মানুষের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। সমালোচনার ঊর্ধ্বে কোনো মানুষ নেই। যে যত বড় মানুষ, তার তত বেশি সমালোচনা। সমালোচনা মানুষকে আরও বিখ্যাত করে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে, বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অতীতেও হয়েছে, বর্তমানেও থেমে নেই। চারদলীয় জোট সরকারের একেবারে শেষের দিকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী তীব্র সমালোচনা হয়েছে। এ সমালোচনায় সত্য-মিথ্যার কোনো বালাই ছিল না, যে যেভাবে পারে সেভাবেই তার সমালোচনা করেছে। একটি সমালোচনার ধরন আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই, ‘চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে তারেক রহমান নাকি শুধু বিদ্যুৎ খাত থেকেই ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। অথচ বাস্তবতা হল, বিদ্যুৎ খাতে জোট সরকারের পাঁচ বছরে সর্বমোট বরাদ্দই ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা।’
বিদ্যুতের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে এ সমালোচনাটি বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় তার প্রতিপক্ষ এবং মানুষ তা বিশ্বাসও করে। কেননা এ সমালোচনার বিপরীতে কোনো প্রতিবাদ তখন ছিল না। কার্যত এ সমালোচনাটির মাধ্যমেই তারেক রহমান জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এ অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকার। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয় প্রায় ১৫টি দুর্নীতি মামলা, যার একটিরও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা সম্ভব হয়নি। গ্রেফতার করে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন; এমনকি নির্যাতন চালিয়ে তার মেরুদণ্ডের হাড় পর্যন্ত ভেঙে দেয়া হয়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি লন্ডনে যান চিকিৎসা নিতে। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন।
তার বিরুদ্ধে সমালোচনা থেমে নেই; চলছে সমান তালে, বিশেষ করে ওই সময়ের ‘হাওয়া ভবন’ নিয়ে নতুন করে সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করছে তার প্রতিপক্ষ। দীর্ঘ সাত বছরেও যার বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির মামলা প্রমাণ তো দূরের কথা অভিযোগ পর্যন্ত গঠন করা সম্ভব হয়নি, তার বিরুদ্ধে নতুন করে সমালোচার কী যুক্তি থাকতে পারে, তা বোধগম্য নয়। এমন সমালোচনা করে কোনো লাভ নেই, যা হিতে বিপরীত হয়। সুতরাং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নতুন করে সমালোচনা তাকে আরও অধিকতর বিখ্যাতই করবে।
যে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির কল্পকাহিনী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল- মানুষ দেখছে সে বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান চিত্র। লোভশেডিং তো বন্ধ হয়ইনি, তা আরও বেড়েছে। গ্রাহকদের ওই সময়ের চেয়ে আরও চার-পাঁচগুণ বেশি বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। এ বর্ধিত বিল দিতে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ অবলীলায় বলছে, আমরা ওই আমলেই ভালো ছিলাম।
তারেক রহমান একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক। তিনি একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় সংগঠক। এটি তিনি কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তৃণমূলের মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। তিনি তাদের অতি কাছে গিয়েছেন। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, যা একজন রাজনীতিবিদের জন্য অপরিহার্য। তিনি যে দল করেন, সে দলের রয়েছে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলাদেশে এ দলটি পাঁচবার সরকার পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশের অনেক ভালো ভালো কাজ এ দলটির মাধ্যমেই হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা, মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু করা, এনজিও’র কর্মকাণ্ড তৃণমূলে বিস্তৃত করা, নারীর ক্ষমতায়ন ও হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পালনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ও টু-স্ট্রোকচালিত যানবাহন বন্ধ করা ইত্যাদি। এসব যুগান্তকারী কাজের মাধ্যমে তৃণমূলে বিএনপির রয়েছে শক্তিশালী ভিত্তি, যা তারেক রহমানের রাজনীতির জন্য তৈরি করেছে অবারিত সুযোগ। তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা যেমন উজ্জ্বল, তেমনি তার এ সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করারও আশংকা রয়েছে। সার্বক্ষণিক নেতৃত্বে আসার আগে তাকে এসব অপরিহার্য দিক বিচার-বিশ্লেষণ অবশ্যই করতে হবে। কেননা নেতৃত্ব একটি অত্যন্ত কঠিন জিনিস। নেতৃত্বের সম্ভাবনা যার মধ্যে বিদ্যমান, তার সঙ্গে স্রষ্টার নৈকট্য আছে। ভুল-ত্র“টি এক সময় মানুষের হয়, এ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই মানুষ পরিশুদ্ধ হয়। নিজের ভেতরে থাকা নেতিবাচক দিকগুলো যিনি চিহ্নিত করতে পারেন- বিখ্যাত মানুষ হতে তার আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না।
ন্যায় ও সত্যের পথ অনুসরণ করতে জনগণকে উৎসাহ প্রদান এবং পরিবর্তন আনয়নে অনুঘটক হওয়ার ক্ষমতাই হচ্ছে সত্যিকারের নেতৃত্ব। কাজেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদারনৈতিক, সংকীর্ণমনা নয়। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব হতে হবে সৃজনমুখী; হতে হবে সংবেদনশীল, কঠোরমনা নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের আমানত হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের প্রভাব, বৈভব বা প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না।
নেতৃত্বের বিভাজন প্রত্যেক দেশেই আছে, আছে আদর্শগত বিরোধও। তাই বলে কি অহেতুক সমালোচনা করে একে অপরকে ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠতে হবে? নেতৃত্বকে কলুষিত করা মানে রাষ্ট্রকে বিপন্ন করা। কেননা নেতৃত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ওতপ্রোত। অহেতুক সমালোচনার প্রভাবে গোটা রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় । কাজেই অহেতুক সমালোচনার আÍঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিতে হবে।
যারা বাংলাদেশ শাসন করার ইচ্ছা রাখেন তাদের একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে; ‘স্ট্র্যাটেজিক’ কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব এখন অপরিসীম। কেননা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ২৫০ কোটি মানুষের বসবাস। আগামী দিনের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ঘিরে। আর বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। তাই শিল্পোন্নত ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ; এখানে একটি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নিরন্তন প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেননা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে পক্ষে রাখতে না পারলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে যে পিছিয়ে পড়তে হবে, এটি উন্নত ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে। তাই বাংলাদেশে তাদের ব্যাপক তৎপরতার দিকটি প্রতীয়মান হচ্ছে। সমালোচনার মাধ্যমে নেতৃত্বের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে তৎপর। কাজেই অহেতুক সমালোচনা করে প্রতিহিংসার জন্ম দেয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমীচীন নয়। তাতে অবধারিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র ও জনগণ। কাজেই এখন ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য বজায় রাখা রাজনীতিকদের জন্য অপরিহার্য।
আমরা প্রায়ই শুনি, ক্ষমতা দূষিত করে। একথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরই দূষিত করতে পারে, যারা দূষণযোগ্য। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ, আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ। বিশ্বাসঘাতক, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ এবং প্রতারক লোকেরাই দুর্নীতি ডেকে আনে। সুতরাং নেতৃত্বের সংস্পর্শে যাতে এসব দোষী মানুষ ঘোরাঘুরি করতে না পারে সেদিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য। কিছু খারাপ মানুষের জন্য তারেক রহমান ও বিএনপিকে অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারলেই এই চড়া মূল্য দেয়ার সার্থকতা থাকবে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.