অস্ট্রেলিয়ার মেধাবী বাঙালিরা by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

বিদ্যাশিক্ষা উপলক্ষে সেই ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। তারপর নানা দেশে ভ্রমণের সুযোগ এলেও এই দ্বীপ মহাদেশে আসার সুযোগ হয়নি, যতক্ষণ না আমাদের সুযোগ্য ছাত্র সহকর্মী এবং সে সময় মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিপসল্যান্ড ক্যাম্পাসের কম্পিউটার বিভাগের প্রধান ড. মঞ্জুর মুর্শেদ সুযোগ সৃষ্টি করল। যা হোক, এবার আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে অনুষ্ঠিত হবে বিধায় আবার সুযোগ হল। কুয়ালালামপুর থেকে উঠেছি ঘণ্টা সাতেকের পথ। সাধারণত খাবার যা দেয়া হয়, তা খেতে না পারলেও ফেলে দিই না।
ব্রিসবেন পৌঁছার পর কাস্টম ডিক্লারেশনের যে ফরম দেয়া হয়, তাতে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর বুঝে না বুঝে লিখতে হয়। আমিও তাই করলাম। তারপর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর যেহেতু মালামাল সবই আমার সঙ্গে নেয়া ৬ কিলোগ্রাম ওজনের ব্যাগে, সেহেতু কাস্টমসে দৈব চয়নে আমাকে যে পরীক্ষা করা হবে, তা ধরেই নিয়েছিলাম। যেহেতু কোনো ফটকেই আমার ভাগ্য নেই। অতি সম্প্রতি আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য নামকরা একটি হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। কত মানুষ প্রবেশ করছে, কিন্তু আমার আর প্রবেশ করা হয় না। পরিশেষে দীর্ঘক্ষণ আমার এতিম অবস্থা দেখে আমাকে একজন পাহারাদার দয়াপরবশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। যা হোক, এত বড় বড় মালামাল রেখে শিকারি ক্ষুদ্র কুকুরটি যখন আমার ব্যাগের কাছে বসে পড়ল, আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে, শক্ত কাগজের মোড়কের ভেতরে বিমানবালা আমাকে যে খাবারটি দিয়েছিল, তার মধ্যে এক খণ্ড মাংসও ছিল। যা হোক, ওই মাংসের টুকরা রেখে তার পরিবর্তে আমাকে একটি রিসিপ্ট ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের সময় কোনো রকম প্রাণিজাত কিংবা উদ্ভিদজাত খাবার নেয়া যাবে না- এরকম একটি লিফলেট দিয়ে আমাকে বিদায় করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ছাত্র ও সহকর্মী ড. নিউটন এসে গেল। নাম দেখে তাকে বিদেশী ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের বাংলাদেশেরই সন্তান। নিউটনের বিচক্ষণ পিতা তার ছেলেমেয়েদের নাম রেখেছে নিউটন, মিল্টন ও লিঙ্কন। সন্তানেরা কিছুটা হলেও নামের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছে। নামের জন্য কোনো না কোনো সময়ে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়নি তা বলা যাবে না, তবে সুস্থির যুক্তিবাদী নিউটন যে যথেষ্ট সফলতার সঙ্গেই তার মোকাবেলা করেছে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বগুড়ার ছেলে নিউটন কোনোদিন ক্ষুদ্র চিন্তা করেনি। পিএইচডি করে ফিরে যখন বিভাগে যোগদান করল, তখন আমরা বিভাগে কোনো একটি বাইরের কাজ করছিলাম। যেখানে ছোটখাটো নানা কাজ আমরা বড় বড় অধ্যাপক ঠাণ্ডা মাথায় বসে করছিলাম, নিউটন তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এই বলে যে, যথেষ্ট বুদ্ধির কাজ না হলে সে করবে না।
নিউটনের ছাত্রজীবনে নানা সময়ে আমি গবেষণা প্রবন্ধ এবং তার সংখ্যাকে গুরুত্ব দিতাম, যা নিউটন কখনও পাত্তা দেয়নি। এবার দেশে এসে খুঁজে দেখলাম অত্যন্ত হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নাল বিএমসি বায়োইনফরমেটিক্সের ভলিউম ১৪তে এ বছর তার দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। উল্লেখ্য, নিউটনের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ Wizard ও Kangaroo ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানী মহলের নজর কেড়েছে। নিউটনের পোস্টডক্টরাল গবেষণার সুপারভাইজার অধ্যাপক সাত্তার নিউটনের কাজ, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। ৬০ বছর বয়সী যশস্বী অধ্যাপক যখন অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী গবেষকের সঙ্গে আলাপে অনেক কিছু শেখা যায় বলে মন্তব্য করেন, তখন উভয়েই যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার। শিক্ষক হিসেবে নিউটনের নজর কাড়তে না পারলেও তার অর্জন আমাকে রীতিমতো গর্বিত করে তুলল। অধ্যাপক সাত্তার আমাদের একাধিক ছাত্রের মেন্টর হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশে আয়োজিত সবচেয়ে নিয়মিত কনফারেন্স আইসিসিআইটিতে মূলবক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করে আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় আমার উভয় ভ্রমণে আতিথ্যকর্তা হিসেবে অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনার দেয়ার পর একটি তুর্কি রেস্টুরেন্টে অধ্যাপক সাত্তারের দেয়া সান্ধ্যভোজ ও আলাপচারিতা অত্যন্ত সুখকর ছিল। এরপর অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে পুরনো সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্কুলের তরুণ পরিচালক বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করার সম্ভাবনা এবং তাতে তার সহায়তার কথা আন্তরিকভাবে জানালেন। আমাদের স্নাতক এবং সেখানে ফ্যাকাল্টি ড. শাহাদাত উদ্দিন একটি সেমিনারের আয়োজন করল এবং তার বাসার আতিথেয়তাও উপভোগ করলাম। আমার সহপাঠী- এক সময়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল ভাই- সারাদিন সিডনির একাংশ পরিভ্রমণ করে দেখালেন। পরিশেষে অস্ট্রেলিয়ার আরেক রাজ্যের রাজধানী পার্থের উদ্দেশে রওনা হলাম। ৫ ঘণ্টার বিমানপথ। ৭ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ঘোষণা শুনে জেগে উঠলাম। বিরূপ আবহাওয়ার জন্য পার্থে নামা সম্ভব হয়নি বলে মেলবোর্নে অবতরণ করতে হয়েছে। যা হোক, পরিশেষে আরেকটি বিমানযোগে পার্থ পৌঁছানো সম্ভব হল।
বিমানবন্দরের বাইরে এসে ব্যাগটি নামিয়ে দু’একটি ছবি তুলছি। এরই মধ্যে নিরাপত্তাকর্মী এসে আমার ব্যাগের পাশে দাঁড়িয়েছে। ব্যাগটি যে আমারই তা বুঝতে পেরে তার সুপারভাইজারকে ওয়াকিটকি ব্যবহার করে আসতে বলল। কোনো মালামাল অরক্ষিত রাখা যাবে না। যা হোক, সুপারভাইজার এসে আমাকে গোবেচারা ভেবে ব্যাগটি দিয়ে দিল। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষক ড. ফেরদৌস সোহেলের আতিথেয়তায় আমাদের স্নাতক ও অন্যান্য বাংলাদেশীর প্রশংসনীয় আন্তরিকতায় সিক্ত হয়ে আরেকখানি সেমিনারে বক্তব্য রেখে দেশের পথে পা বাড়ালাম।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.