রাজনীতিতে শুরু রাজনীতিতেই শেষ by লুৎফর রহমান

মো. জিল্লুর রহমান। আজীবন তিনি ছিলেন রাজনীতির মানুষ। একজন শুদ্ধ রাজনীতিবিদ। নির্লোভ, নির্মোহ নেতা। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দল ও জাতির বিশ্বস্ত সহচর।
দলের ক্রান্তিকালে সাহসী ভূমিকা রেখে ওই ক্রান্তিকাল উতরে দলকে ক্ষমতার মসনদে নিতে সাহসী  ভূমিকা রাখেন জিল্লুর রহমান। দল তার সেই ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন করে তাদের জাতির অভিভাবক নির্বাচিত করে বঙ্গভবনে পাঠায়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত এই সহযোগী বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। জিল্লুর রহমান রাজনীতিতে জড়ান ছাত্রজীবন থেকেই। আর তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয়। জীবন শুরু এই রাজনীতি দিয়েই। আর রাজনীতিতেই শেষ করলেন জীবনের শেষ অধ্যায়। দেশের ১৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করে তিনি রেখে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনীতি থেকে উঠে আসা একজন শুদ্ধ রাজনীতিকের দক্ষতার স্বাক্ষর।
জিল্লুর রহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ৯ই মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানায়। পিতা মেহের আলী মিয়া ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী। জিল্লুর রহমান ময়মনসিংহ কেবি হাই স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাটিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য জিল্লুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং তার মাস্টার্স ডিগ্রি বাতিল করা হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জন্য গঠিত নির্বাচন স্টিয়ারিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি সফলতার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন জিল্লুর রহমান। ৬০-এর দশকে জিল্লুর রহমান ঢাকা জেলা বার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ১৯৪৭ সালে জিল্লুর রহমান সংশ্রব পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন, ’৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ সকল গণ-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পাশে থেকে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন জিল্লুর রহমান। স্বাধীনতার পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান প্রণয়নে জিল্লুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জিল্লুর রহমান ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদের তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এ সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবেও ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর ১৬ই জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হলে জিল্লুর রহমান দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে দলের নেতৃত্ব দেন। তখন তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিল্লুর রহমান ষষ্ঠবারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে এই দায়িত্ব পান। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা পালন করায় জিল্লুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৯২ সালে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি তৃতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১/১১-এর পর আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে ২০০৭ সালে শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করতে মুজিব কোট কিংবা পাঞ্জাবির বদলে গাউন পরে সংসদ ভবনের বিশেষ আদালতে দেখা যায় প্রবীণ এই নেতাকে।
আপাদমস্তক রাজনীতিক জিল্লুর রহমানের বিয়েতেও রাজনীতি ছিল বিষয়। অভিজাত পরিবারের সন্তান আইভী রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করার সুবাদেই পরিচয়, এরপর পরিণয়। তবে তাদের দু’জনকে এক করতে দুই পরিবারকে রাজি করাতে উদ্যোগ নিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। সক্রিয় রাজনীতিক আইভী রহমান ছিলেন নিজের পরিচয়েই পরিচিত। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীও ছিলেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.