ত্বকী হত্যার ব্লুপ্রিন্ট by লায়েকুজ্জামান

বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে: বাসার ৫০০ গজের মধ্য থেকে অপহরণ করা হয় ত্বকীকে। এই দূরত্বে সুধীজন পাঠাগার। একই দূরত্বে শহরের গলাচিপা এলাকায় তার নানার বাসা। ত্বকীর যাতায়াতের গণ্ডি ছিল এই দুই স্থানে।
৬ই মার্চ সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয় তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। মা-বাবাকে বলে যায় বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি। বাসা থেকে বের হয়ে সে আর ফেরেনি। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, পাঠাগার বা নানার বাসার দিকে যাওয়ার পথেই ত্বকীকে অপহরণ করা হয়। স্কুলছাত্র ত্বকীর ফেসবুক আইডি-ও ছিল। তার লাশ উদ্ধারের দুই ঘণ্টার মধ্যেই কে বা কারা তার ওই আইডি নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। পরিবারের বক্তব্য ও এসব সূত্র ধরে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ধারে মাঠে নেমেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তবে তাদের ধারণা জড়িত সন্দেহের তালিকায় থাকা অন্তত ৪ জন দেশত্যাগ করেছে। এ পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ৬ জনকে। আটককৃতদের একজন শহরের একটি প্রভাবশালী পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। খুনের মোটিভ হিসেবে তিনটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ। ত্বকী অপহরণ ও খুনের ঘটনায় পুলিশি ব্যর্থতা নিয়ে তোলপাড় চলছে নারায়ণগঞ্জে। পরিবারসহ নিকটজনদের বক্তব্য পুলিশের কাছে নালিশ জানানোর পরপরই পুলিশ টর্চার সেলগুলোতে হানা দিলে হয়তো জীবিত উদ্ধার করা যেতো ত্বকীকে। পুলিশ, র‌্যাব-এর গাফিলতির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। খুনিদের বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। গঠিত হয়েছে ত্বকী মঞ্চ। আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রতিদিন সমাবেশ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ শহীদ মিনারে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে তারা জানতে পেরেছে সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে গলাচিপায় নানীর বাসায় যাওয়ার পথেই অতি দ্রুত গাড়িতে তুলে নেয়া হয় ত্বকীকে। এমনভাবে তাকে গাড়িতে তোলা হয় পাশের লোকেরাও বিষয়টি টের পায়নি। নিহত ত্বকীর বাসার মাত্র ৫০ গজের মধ্যে র‌্যাব নারায়ণগঞ্জের প্রধান কার্যালয়। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, দুর্ধর্ষ কোন বাহিনী ছাড়া জনবহুল ওই এলাকা থেকে কাউকে অপহরণ করা সম্ভব নয়। নিহত ত্বকীর লাশটিও পাওয়া যায় তাদের বাসা থেকে মাত্র ৩শ’ গজের দূরত্বে শীতলক্ষ্যার পাড়ে। অপহরণ খুন ও লাশ পাওয়ার স্থানগুলো পরদিন হরতালের কারণে ছিল নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে। কিভাবে ওই জনবহুল এলাকা থেকে একজন মানুষকে অপহরণ করা হলো, আবার হত্যা করে লাশ ফেলে আসা হলো- সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাঝেও। নিহত ত্বকীর লাশ পাওয়ার পরই নারায়ণগঞ্জ শহরের নিজ বাড়ি থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় চার কিশোর। পরস্পরের বন্ধু নানা কারণে শহরে আলোচিত, পরিচিত  ওই চারজনই নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ পরিবারের কিশোর প্রজন্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে দাবি ত্বকীর পরিবারের। গোয়েন্দা সূত্রের মতে রাজীব দাস, সালেউর রহমান সীমান্ত, ছোট পারভেজ ও রাজীব সন্দেহভাজন ওই চার জনই দেশে ছেড়ে পালিয়েছে তাদের আরেক ঘনিষ্ঠ রিফাতকে আটকের খবর পাওয়ার পর। তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে এখনও অন্ধকারে পুলিশ। এমন একটি নিষ্পাপ নিরপরাধ ছেলেকে কেউ এমন পরিকল্পিতভাবে খুন করতে পারে তার হিসাব মেলাতে পারছে না পুলিশ বিভাগও। তবে জানা গেছে, টিনএজ ক্রাইম, রাজনৈতিক বিরোধ ও পারিবারিক বিরোধ ওই তিনটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ। সূত্রমতে পুলিশ খতিয়ে দেখছে ইভটিজিং বা মেয়েলি অন্য কোন বিষয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা। নিহত ত্বকীর একটি ফেসবুক আইডি ছিল। ত্বকীর লাশ উদ্ধারের দুই ঘণ্টার মধ্যে ফেস বুক আইডি ডি-অ্যাকটিভ করা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে কারা ত্বকীর ফেসবুক আইডি ডি-অ্যাকটিভ করলো সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার পিতা রফিউর রাব্বীও স্বীকার করেছেন ত্বকীর একটি ফেসবুক আইডি ছিল ২০১২ সালে সেটা খোলা হয় তবে সে ফেসবুকে খুব কম বসতো। নিহত ত্বকী ছিল এবিসি স্কুলের ফার্স্ট বয়। তার ক্লাসের সেকেন্ড বয় চাষাঢ়া এলাকার আরমান নামের একটি ছেলে। ত্বকীর ফেসবুক আইডি ডি-অ্যাকটিভ করার আগে তার বন্ধু আরমানের ফ্রেন্ড লিস্টে মোট ১১ জন বন্ধু ছিল। ওই ১১ জন বন্ধুর তালিকায় প্রথম শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের এবং ১১ নম্বর নাম ছিল নিহত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর। আরমানের ফেসবুকে দ্বিতীয় নামটি হানি নামের এক কিশোরীর, সূত্রমতে হানি হচ্ছে অয়ন ওসমানের চাচাতো ভাই আজমিরী ওসমানের বান্ধবী। অয়ন ওসমানের ফেসবুকে ৪৬৬২ জন বন্ধুর মধ্যে নিহত ত্বকীর নাম দেখা যায়নি। অয়ন ওসমানের  ফেসবুকে সমপ্রতি সময়ে অসংখ্য লেখা আছে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র আইভীর সম্পর্কে অনেক কটূক্তি। ফেসবুক ছাড়াও স্কুলের বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে ত্বকীর সঙ্গে কোন ঝামেলা আছে কিনা সে বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ত্বকীর পিতা রাফিউর রাব্বীর সঙ্গে তার বড় ভাই এমএ রাব্বী ছদ্মনাম ওয়াহেদ রেজার জমিজমা নিয়ে পুরনো বিরোধ আছে প্রায় ২০ বছর ধরে। ওই বিরোধ মেটানোর জন্য এক সময়ে এমএ রাব্বী শামীম ওসমানেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। শামীম ওসমান সালিশ বৈঠক করতে চাইলেও তাদের কোন পাত্তা দেননি রাফিউর রাব্বী। জমি-জমার ওই বিরোধটিও খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ত্বকীর পিতা রাফিউর রাব্বী প্রকাশ্যে বলছেন, শামীম ওসমানের সঙ্গে তার বিরোধ আছে এবং সে বিরোধ রাজনীতি নিয়ে। রাজনীতির বিরোধের ওই বিষয়গুলোও আমলে নিয়েছে পুলিশ।
রাফিউর রাব্বী নারায়ণগঞ্জ শহরে পরিচিত মুখ ছাত্র জীবন থেকে। তারা পিতা ডা. এস হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। রাব্বী ছাত্রজীবনে ছিলেন বাম ঘরানার ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। সিপিবি’র নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে জড়িয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। রাফিউর রাব্বী জানান, নারায়ণগঞ্জে বাসভাড়া বৃদ্ধিতে শামীম ওসমানদের বাধা দেয়ার সময় থেকে তার সঙ্গে ওসমান পরিবারের বিরোধ শুরু হয়। পরবর্তীকালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ করে ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়া ওসমান পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ পাকাপোক্ত হয়ে যায়। তিনি মনে করেন সে কারণেই তার ছেলে ত্বকীকে হত্যা করেছে শামীম ওসমান।
গত ৮ই মার্চ ত্বকীর লাশ উদ্ধারের পর তার পিতা অজ্ঞাতনামা লোকদের নাম উল্লেখ নারায়ণগঞ্জ থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। গত ১৮ই মার্চ রাত ৯টায় তিনি নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কাছে আগের দায়ের করা এজাহারের বর্ধিত হিসেবে আসামিদের নাম উল্লেখ করে একটি এজাহার দায়ের করেন।  নতুনভাবে দেয়া এজাহারে তিনি শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ আরও ৫ জনের নাম উল্লেখ করেন। অন্য পাঁচজন হচ্ছেন- জেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক ক্যাঙ্গারু পারভেজ, জাপা নেতা হাজী রিপনের ছেলে সালেউর রহমান সীমান্ত, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজীব দাস, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, ও রিফাতের নাম। এর মধ্যে রিফাতকে আটক করেছে পুলিশ।
পুলিশ স্বীকার না করলেও নিশ্চিত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত ডিবি ও থানা পুলিশ ওই ঘটনায় মোট ৫ জনকে আটক করেছে। এরা হচ্ছে রিফাত, হৃদয়, শ্যামল, মেহেদী খন্দকার ও রুমি। তবে এখনও তাদেরকে ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।
রাফিউর রাব্বী বলেন, ত্বকীর অপরাধে নয়, আমার অপরাধে, আমার সঙ্গে বিরোধের কারণে ত্বকীকে খুন করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশ যদি আমি জিডি করার পরই ব্যবস্থা নিতো, টর্চার সেলে হানা দিতো তা হলে হয়তো ছেলেকে জীবিত পেতাম। এখনও পুলিশ আসামি ধরার ক্ষেত্রে ছক বাঁধা কথা বলে যাচ্ছে, হয়তো কোন জজ মিয়া নাটক সাজাবে। তবে বলে দিচ্ছি কোন জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে পার পাওয়া যাবে না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক এমপি শামীম ওসমান বলেন, আজ কিছু বলবো না। আগামীকাল নারায়ণগঞ্জে বসে সব কথা বলবো, দেশবাসীকে সব সত্য জানাবো, রাজনীতিকে কলঙ্কিত করতে কারা ওই ষড়যন্ত্র করছে।

No comments

Powered by Blogger.