নির্মাণ চুক্তি এবং অর্থায়নে অগ্রগতি নেই- রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র by সোহেল রহমা

শ্লথ হয়ে পড়েছে পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ। এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনৰম বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের লৰ্যে গত বছরের মে মাসে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতাস্মারক হলেও এখনও চূড়ানত্ম চুক্তি করতে পারেনি বাংলাদেশ।
কেন্দ্র নিমর্াণে বিপুল অর্থের যোগান কীভাবে আসবে, তাও পরিষ্কার নয়। তবে বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ড. ইয়াফেস ওসমান বলেছেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের কাজ আমরা শুরম্ন করে যাব। এ ব্যাপারে আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছি।
চীন, যুক্তরাষ্ট্র, দৰিণ কোরিয়ার পর গত বছরের মে মাসে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণে সমঝোতাস্মারক স্বাৰর করে বাংলাদেশ। সমঝোতা করেও কেন্দ্র নিমর্ানের সহায়তা থেকে পিছু হটে আগের তিনটি দেশ। তবে স্বপ্ন বাসত্মবায়নের পথে শেষ পর্যনত্ম এগিয়ে আসে রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে স্বাৰর করা সমঝোতাস্মারক অনুযায়ী বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্ানে দেশটি অবকাঠামোগত নিমর্াণ, বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা, জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দেবে। প্রথম দফায় দু'টি পস্নান্টের প্রতিটিতে ৫শ' করে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদনের সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার।
এর পর চূড়ানত্ম চুক্তি স্বাৰর করতে গত বছরের অক্টোবরে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাশিয়া সফরে যায়। দলটি রাশিয়ার কয়েকটি বিদু্যত কেন্দ্র পরিদর্শন, নিমর্াণের আর্থিক ও কারিগরি দিক সম্পর্কের ধারণা নিলেও চূড়ানত্ম চুক্তি করতে পারেনি। পরবতর্ীতে বাংলাদেশ থেকে চুক্তির একটি খসড়াও রাশিয়ার কাছে হসত্মানত্মর করা হয়। প্রতিমন্ত্রী ড. ইয়াফেস ওসমান জানিয়েছেন, বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের আগে দুই দেশের মধ্যে সরকারীভাবে আরেকটি চুক্তি স্বাৰর করতে হবে। আমরা ইংরেজী, রাশান ও বাংলা ভাষায় চুক্তির একটি খসড়া চূড়ানত্ম করেছি। চুক্তিটি স্বাৰরিত হলেও আমরা কাজ শুরম্ন করতে পারব বলে আশা করি। তিনি জানান, বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের কাজ শেষ করতে প্রায় সাত বছর লাগবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই আমরা কেন্দ্র নিমর্াণের কাজ শুরম্ন করে দিয়ে যাব।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পারমানবিক বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণে রাশিয়া অবকাঠামোগত নিমর্াণ, বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা, জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দিকে রাজি হয়েছে। তবে কেন্দ্র নিমর্াণে আর্থিক দিকটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। চূড়ানত্ম হয়নি অর্থের সংস্থানও । মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্র নির্মাণে চূড়ানত্ম চুক্তির আগে রাশিয়া আর্থিক সহায়তার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রম্নতি দেয়নি। তবে মঞ্জুরি সহায়তার পরিবর্তে সহজশর্তে ঋণ দিতে রাশিয়া তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে রাশিয়ান প্রতিনিধি দলের আলোচনার কথা থাকলেও পরে তা আর হয়নি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রি-এ্যাক্টর প্রযুক্তিতে বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের প্রসত্মাব দিয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাশিয়া বর্তমানে ৩১ টি কেন্দ্রের মাধ্যমে ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন করছে। পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন রি-এ্যাক্টর প্রযুক্তি দিয়ে ফ্রান্সের বিদু্যত চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪৩৯ টি রি-এ্যাক্টর চুলিস্ন রয়েছে। এর মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রয়েছে ১৩৬ টি। প্রতিবেশী ভারতে ১৭ টি চুলিস্ন থেকে ৪ হাজার ১২০ মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন করা হয়। পাকিসত্মানে দু'টি চুলিস্ন থেকে ৪২৫ মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন করা হয়। এছাড়া ভারতে আরও ১৭ টি এবং পাকিসত্মানে ৬ টি চুলিস্ন নিমর্াণাধীন। গত এক বছর রাশিয়া, ভারত, আর্মেনিয়া, হাঙ্গেরি, উজবেকিসত্মান, সেস্নাভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, বুলগেরিয়া এবং জার্মানিতে ৬৫ টি পস্নান্ট সরবরাহ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪৩৯ টি পারমানবিক কেন্দ্র থেকে বর্তমানে মোট চাহিদার ১৬ শতাংশ বিদু্যত সরবরাহ করা হয়।
পরমাণু শক্তির শানত্মিপূর্ণ ব্যবহারের নিশ্চয়তা দিয়ে বাংলাদেশ আইইএর সঙ্গে ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যনত্ম পাঁচটি চুক্তি ও সমঝোতা কনভেনশনে স্বাৰর করেছে। এছাড়া পরমাণু অস্ত্র বিসত্মাররোধ, পারমাণবিক নিরাপত্তামূলক ব্যাপকভিত্তিক পরমাণু পরীৰা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি এবং পারমাণবিক সন্ত্রাসসহ সাতটি কনভেনশনভুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পারমাণবিক শক্তির শানত্মিপূর্ণ ব্যবহারে করতে বাংলাদেশকে অনুমতি দেয় আইইএ।
পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের জন্য সরকারের পৰ থেকে রাশিয়ার পাশাপাশি চীন ও দৰিণ কোরিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু চীন ও কোরিয়া আগ্রহী না হওয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে কেন্দ্র নিমর্াণের কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা শুরম্ন করে সরকার। ২০০৫ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে পরমাণু শক্তির শানত্মিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে একটি চুক্তি স্বাৰরিত হয়েছিল। পরের বছরের জুলাই মাসে বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের জন্য চীনের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রসত্মাব পাঠায় বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা সম্ভব নয় বলে জানায় চীন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দৰিণ কোরিয়ার কাছে ৯০ কোটি ডলার সহায়তা চেয়ে বাংলাদেশের পৰ থেকে প্রসত্মাব পাঠানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রসত্মাবে কোন সাড়া দেয়নি কোরিয়া। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও একটি সমঝোতাস্মারক স্বাৰরিত হয়েছিল।
গত কয়েক বছর ধরে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ না থাকায় বিদু্যত খাতে বর্তমানে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশে বর্তমানে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যতের ঘাটতি রয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে বিদু্যত উৎপাদন সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে সাত হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এছাড়া ২০২১ সালে সকলের কাছে বিদু্যত সুবিধা পেঁৗছে দেয়ার অঙ্গীকার করেছে সরকার। নির্বাচনী অঙ্গীকারে আওয়ামী লীগ পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
১৯৬১ সালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। সে লৰ্যে সে সময়ে ২৯২ একর জমিও অধিগ্রহন করা হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিসত্মান আমলে ৭০ মেগাওয়াট, ১৯৬৬ সালে ১৪০ মোগওয়াট, ১৯৬৯ সালে ২শ' মেগাওয়াট পস্নান্ট স্থাপনের সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে ১২৫ মেগাওয়াট ৰমতাসম্পন্ন পারমাণবিক জ্বালানি পস্নান্ট স্থাপনের সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পারমাণবিক বিদু্যত কেন্দ্রটি ৬শ' মেগাওয়াট করার সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়। ২০০১ সালে প্রকল্পটিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউকিয়ার পাওয়ার এ্যাকশন পস্নান্টের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আনত্মর্জাতিক আণবিক সংস্থা বাংলাদেশকে পরমাণ বিদু্যত কেন্দ্র নিমর্াণের অনুমতি দেয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮-০৯ সালের মধ্যে রূপপুর পরমাণু বিদু্যত প্রকল্প বাসত্মবায়নের প্রয়োজনীয় প্রসত্মুতিমূূূলক কাজ শেষ করার বিষয়ে একটি বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প(এডিবি) হাতে নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে রাশিয়া, চীন ও কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরম্ন করে বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.