জমির মালিক না হওয়ায় শ্রম দিয়েও কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি নেই কৃষিতে নারী by নাজনীন আখতার

 ভোর ৫টার আগেই ঘুম থেকে ওঠেন শেফালী বেগম। বাড়ি বগুড়া জেলার গাবতলীতে। ঘুম থেকে উঠেই স্বামীর সঙ্গে নেমে পড়েন মাঠের কাজে। ঘণ্টা দু'য়েক কাজ করার পর বাড়ি ফিরে পরিবারের সবার জন্য নাসত্মা তৈরি করেন।
এর পর ফিরে যান মাঠে। সেখান থেকে দুপুরের আগে আগে ফিরে এসে রান্নাবান্না করেন। এটাই তার প্রতিদিনকার রম্নটিন। দিনের কাজের অর্ধেকভাগ মাঠে আর অর্ধেক ভাগ সংসারে। এবার শীতে বাড়ির পাশের দুই বিঘা জমিতে আলু করার সিদ্ধানত্ম নেন স্বামী এমদাদ হোসেন। এর পর থেকেই জমি চষে বীজ তৈরি, বীজ তোলা, গন্ধ শুঁকে ভাল বীজ আলাদা করা, সাতদিন পর সেই বীজ বোনা_ সব কিছুই তিনি করলেন। আলুর ফলনও খুব ভাল হয়েছে। শেফালী বেগম এখন আলু বসত্মায় ভরে বাজারজাত করার প্রসত্মতি নিচ্ছেন। তার দায়িত্ব শেষ। গেল বছরের মতো এবারও বাকি কাজ করবেন তার স্বামী। ব্যাপারীর কাছে আলু বিক্রি করে টাকা আনবেন। সে টাকার চেহারা দেখারও সুযোগ পাবেন না শেফালী বেগম। আলু চাষে পুরো তিন মাস শ্রম দিয়েও তিনি কৃষক নন। তিনি ছায়া কৃষক। শুধুই নেপথ্য কারিগর।
গ্রামের ৪১ শতাংশ সংসারী নারী আলু চাষে জড়িত থাকলেও জমির মালিক না হওয়ায় কৃষক হিসোব তাদের স্বীকৃতি নেই। মাত্র ১ শতাংশ নারী কৃষক হিসেবে উৎপাদনের শেষ প্রক্রিয়া অথর্াৎ সরাসরি অর্থ উপার্জন করতে পারছেন। চিহ্নিত হচ্ছেন কৃষক হিসেবে। ভুট্টা, সবজি, মাছ চাষ ও হাঁস-মুরগি পালনের ৰেত্রেও একই চিত্র। বাংলাদেশের কৃষি খাতে জেন্ডার প্রভাব এবং এ খাতের উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণ নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সদ্য সমাপ্ত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য। খুব শীঘ্রই গবেষণাটি প্রকাশ করা হবে।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. প্রতিমা পাল মজুমদারের এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী কৃষিকাজে জড়িত থেকে অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখলেও এ খাতে একক সিদ্ধানত্ম গ্রহণ ও পণ্য বাজারজাতকরণে একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে। কোন কোন ৰেত্রে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ পযর্ায় পর্যনত্ম থাকলেও বাজারজাত করার মুহূর্তে শ্রম দেয়া নারীরা থাকেন অনুপস্থিত। চাষের জন্য জমি তৈরি, বীজ প্রস্তুত, ভাল মানের বীজ পরীৰা করে যাচাইবাছাই করা, ফসল ফলানো, তোলা ও সংরৰণ এবং বাজারজাতকরণের সময় পূণর্াঙ্গ সাহায্য করলেও খুব কম সংখ্যক নারীকে কৃষক বলে চিহ্নিত করা হয়।
গবেষকদের মতে, শতভাগ শ্রম দিয়েও সেই নারীরা ছায়া কৃষক হয়েই কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজারজাত প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার মাধ্যমেই নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। আর এটা ছাড়া কৃষিতে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে না কখনই। এদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী জানালেন, এ সরকার নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও শ্রম বাজারে সহজে প্রবেশ নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সে লৰ্যেই কাজ করছে সরকার।
কৃষিতে বাড়ছে অংশগ্রহণ, প্রবেশ নেই বাজারজাতকরণে
ইতিহাস বলে, কৃষির উদ্ভাবনই হয় নারীর হাতে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নারীরা ঝোঁপজঙ্গল থেকে এটা-সেটা এনে খাওয়ার উপযোগী করতেন। অবশিষ্টাংশ ফেলে দিতেন। নারীরাই লৰ্য করলেন, ফেলে দেয়া অংশ বা বীজ থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন শস্য। সেই শুরম্ন। তবে কৃষিতে প্রযুক্তি যোগ হওয়ার পর দূরে সরিয়ে দেয়া হয় নারীদের। এর পরও সময়ের প্রয়োজনে দিনে দিনে আবারও কৃষিতে অংশগ্রহণ বাড়ে নারীর।
এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. প্রতিমা পাল মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, আবহমান কাল থেকেই কৃষিতে নারীর অবদান ছিল। এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। এখন দিনে দিনে তা আরও বাড়ছে। গ্রামীণ নারীদের ছাড়া কৃষি খাতের কথা এখন কল্পনাই করা যায় না। তারা এতটাই শ্রম দিচ্ছে। তবে জমির মালিকানা না থাকায় অর্থ উপার্জনের মতো চূড়ানত্ম সুবিধা ভোগ করতে গিয়ে তাদের স্বামী বা পরিবারের পুরম্নষ অভিভাবকের ওপর নির্ভর করতে হয়। বলা যায়, শস্য বাজারজাতকরণে নারীর অংশগ্রহণের সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। আর্থ-সাামজিক প্রেৰাপটের কারণে এক ধরনের সংস্কার এতে বাধা হয়ে আছে। বাজারে নেয়ার জন্য শস্যের বসত্মা বাঁধার কাজটি পর্যনত্ম ওই নারী করে দিলেও বাজারজাতকরণে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তার হাতে।
কৃষির বিভিন্ন ৰেত্রের কথা তুলে ধরে বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়, আলু খাতে সংসারের সমসত্ম কাজের পাশাপাশি আলু চাষে সময় দেন ৪১ শতাংশেরও বেশি নারী। এর মধ্যে ১২ শতাংশ আলুর ভরা মৌসুমে পুরো সময় দেন। তবে কৃষক হিসেবে সুফল ভোগ করেন মাত্র ১ শতাংশ নারী। গ্রামীণ নারীদের একটি বড় অংশ হাঁস-মুরগি পালন ও মৎস্য চাষে জড়িত থাকলেও তারাও কৃষক হিসেবে চিহ্নিত নন। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু মাছ চাষের সঙ্গেই সরাসরি জড়িত ৪৮ শতাংশ নারী।
একক সিদ্ধানত্মে বাধা এক নারী আৰেপ করে বলেছিলেন, 'গত বছর আমি আমার স্বামীকে বেগুন চাষে পীড়াপীড়ি করেছিলাম। এক সময় তিনি চাষ করতে রাজি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেবার বেগুন থেকে আমরা লাভ করতে পারিনি। লোকসানের কারণে তিনি ক্রমাগত আমাকে দোষ দিতে থাকেন। কি সহজেই না আমার স্বামী আমাকেই দায়ী করে যাচ্ছিলেন। অথচ তিনি যদি নিজে বেগুন চাষের সিদ্ধানত্ম নিতেন, আর লোকসান করতেন। আমি কখনও এভাবে তাকে দোষ দিতাম না।'
সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়েও চাষের কোন পযর্ায়েই এককভাবে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করতে পারে না নারীরা। স্বামীর তিরস্কারের ভয়ে সিদ্ধানত্ম গ্রহণে সাহস করেও উঠতে পারেন না তারা।
এ প্রসঙ্গে ড. প্রতিমা পাল মজুমদার বলেন, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও স্থানীয় এনজিওদের কারণে অনেক নারী চাষাবাদে এককভাবে সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত। তারা কোন ধরনের প্রশিৰণপ্রাপ্ত না হয়েও ঠেকে ঠেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বিশেষ করে মাছ চাষ ও হাঁস-মুরগি পালনে গ্রামের এ নারীরা বলেছেন, তারা সঠিক সিদ্ধানত্ম নিতে পারেন। মাছ চাষের ৰেত্রে ৩৪ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা এককভাবে সিদ্ধানত্ম নেন এবং তাদের সিদ্ধানত্ম সঠিক হয়।
অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের মতে, সচেতনতা বাড়াতে পারলে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কৃষিকাজের সুফল নারীরা সরাসরি ভোগ করতে পারবে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মাঠে-ঘাটে গিয়ে অনেক গবেষণা করেছি এ বিষয়ে। দেখা গেছে, নিজের শ্রম দিয়ে উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে উপার্জন করতে পারছেন না নারী কৃষকরা। এ টাকা সম্পূর্ণই চলে যাচ্ছে পুরম্নষ অভিভাবকের হাতে। অধিকাংশ ৰেত্রে কত টাকার শস্য বিক্রি হলো সেটা পর্যনত্ম জানতে পারেন না তারা। অথচ ফসল ফলানো থেকে শুরম্ন করে ফসল তোলা পরবতর্ী সময়ের কাজের পুরোভাগে থাকেন নারীরা। এমনকি ফসলের জন্য ৰুদ্র ঋণের প্রয়োজন হলেও সেটাও ওই নারীর নামেই আসে। অথচ অর্থ চলে যায় পরিবারের পুরম্নষের হাতে। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই জরম্নরী।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষিতে নারী গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে অন্যান্য ৰেত্রের মতো কৃষিতেও নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে বাজারে প্রবেশের ৰেত্রে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে এ সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও শ্রমবাজারে প্রবেশের ৰেত্রে সুনির্দিষ্ট লৰ্যমাত্রা নিধর্ারণ করা হয়েছে। অভীষ্ট লৰ্যে পৌঁছানোর জন্য সরকার আনত্মরিকভাবে চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, সরকার ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি পুনর্বহাল করেছে। এর বাসত্মবায়ন শুরম্ন হলে নারীরা কৃষিৰেত্রেও পূর্ণ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
তবুও আশার আলো
'আমাদের স্বামীরা বাজারে, শহরে যায়, অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলে। আমরা সব সময় বাড়িতেই থাকি। তাই যা শেখার তা শিখি সমিতি থেকে, একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে।' বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে কয়েক নারীর এমন সাবলীল মনত্মব্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজ তাগিদেই কৃষিতে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে চলছে গ্রামের কৃষক নারী। কৃষিতে যতটুকু প্রশিৰণের ব্যবস্থা আছে তাতে কৃষক হিসেবে পরিবারের পুরম্নষ সদস্যই প্রশিৰিত হতে পারেন। ফলে প্রশিৰণের মাধ্যমে ভালভাবে শস্য উৎপাদনের কোন তথ্য জানতে পারে না নারী। তবে অনুসন্ধিৎসু হওয়ায় আশাতীতভাবে তারা শিখে চলেছেন। সেৰেত্রে উৎস হিসেবে কাজ করছে মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন এবং এনজিও। যেখানে বিদু্যত নেই, সেখানে তথ্য সরবরাহের ৰেত্রে রেডিও এবং এনজিও বড় ভূমিকা রাখছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাভজনক ফসল উৎপাদনের জন্য মরিয়া নারী কৃষকরা প্রথম অবস্থায় তথ্য খোঁজে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও অন্য কৃষকদের কাছে। ৬৮ শতাংশ নারী এভাবে কৃষি বিষয়ে শিৰা নেন। এ নারীদের কাছে রেডিও এবং টেলিভিশনের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান অত্যনত্ম জনপ্রিয়। প্রযুক্তির সঙ্গে কিছুটা পরিচিত নারীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাজারে শস্যের দামের বিষয়ে ভাল খোঁজ রাখেন। ১২ শতাংশ নারী সংবাদপত্র এবং বিলবোর্ডের মাধ্যমে খোঁজখবর রাখেন। ভুট্টা চাষের ৰেত্রে অর্ধেকের বেশি নারী জানেন, পানি ও রাসায়নিক সারের ঘাটতি হলে ফলন কমে যায়। মৎস্য চাষের ৰেত্রে ৮০ শতাংশ নারী যথাযথভাবে পুকুর তৈরি, কোন্ খাবার মাছের জন্য উপযুক্ত, অতিরিক্ত খাবার দিলে পুকুরে তা পচে গিয়ে মাছের জন্য ৰতিকর বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়, পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখার উপায় সম্পর্কে জানেন। আলু চাষের ৰেত্রে শতভাগ নারী জানেন, কীভাবে ভাল উৎপাদন সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.