ফিরে দেখা ॥ সাতই মার্চ by বাহাউদ্দীন চৌধুরী

ঐতিহাসিক সাতই মার্চ চলে গেল। এই দিনটি বাঙালী জাতির জীবনে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। দিনটি বাঙালীর স্বাধীনতার লড়াইয়ের একটি উজ্জ্বল মাইলফলক। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ রমনার বিশাল জনসুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীনতার ঘোষণা সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেন।
তার ঘোষণায় কোন দ্বিধা বা অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি আরও বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই দিয়ে পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর বিরম্নদ্ধে লড়াই কর। স্বাধীনতার এর চাইতে স্পস্ট ঘোষণা আর কি হতে পারে। বস্তুত, সেদিন থেকেই বাঙালীর স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই শুরম্ন হয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান পর্যনত্ম তার লেখায় সাতই মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতাযুদ্ধের গ্রীন সিগন্যাল বলে উলেস্নখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়ারলেসে স্বাধীনতার চূড়ানত্ম ঘোষণা না দিলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকাশ্য জনসভায় লাখো লাখো বাঙালীর সমাবেশে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন করার জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল। অথচ, কিছু কুচক্রী স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তারা দাবি করেন একাত্তরের পঁচিশে মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান নিজে কখনও এই দাবি করেননি। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, পঁচিশে মার্চে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীর জন্য আনা অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন। জনতা রাসত্মায় ব্যারিকেড দিয়ে বাধার সৃষ্টি করেছিল। জিয়াউর রহমান ব্যারিকেড সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। জনতা তার কথা না শোনায় তিনি গুলিবর্ষণের হুমকি দিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে মেজর রফিক এবং ক্যাপ্টেন অলি আহমদ এসে তাকে জানায় যে বাঙালী অফিসারও সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হচ্ছে। এই কথা শুনে তিনি ভয় পেয়ে যান। তখন তাকে বিদ্রোহ করায় অনুুরোধ জানানো হয়। তিনি রাজি হন। এরপরে কালুরঘাটে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন কিছু বাঙালী বেতারকর্মী। জিয়াউর রহমান সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালী সামরিক অফিসার হওয়ায় তাকে বঙ্গবন্ধুর ছাবি্বশে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করতে অনুরোধ করেন তারা। তিনি সাতাশে মার্চ এই ঘোষণাটি পাঠ করেন। অবশ্য এর আগেই চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হান্নান ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন। বেতারকর্মী আবুল কাশেম সন্দীপও ঘোষণাটি পাঠ করেন। আরও একজন বেতারকর্মী ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রকৃতপৰে, জিয়াউর রহমান ঘোষণাটির চতুর্থ পাঠক ছিলেন। পঁচিশে মার্চে জিয়াউর রহমানের এই জাতীয় ঘোষণা দেয়ায় প্রশ্নই আসে না। কারণ তিনি তখন পাকিসত্মান সামরিক বাহিনীর একজন অনুগত অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিসত্মানী সৈন্যদের জন্য আনা অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমান তার যৌবনকাল থেকেই পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর বিশ্বসত্ম অনুগত কর্মচারী ছিলেন। তিনি পড়াশুনাও করেছেন করাচির ইসলামিয়া কলেজে। বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে তার পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি। তিনি ভাল বাংলা জানতেন না। চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি পাকিসত্মানী সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে অত্যনত্ম বিশ্বসত্ম ও অনুগত অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি পাকিসত্মানী হিসেবে গৌরববোধ করতেন, বাঙালী হিসেবে নয়। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে তার কোন সংশ্রবই ছিল না। অথচ অর্বাচীনরা তাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করে। বঙ্গবন্ধুর সারা যৌবনকালে পাকিসত্মানী কারাগারে বন্দী থেকেছেন। স্ত্রী ও সনত্মানদের সঙ্গে থাকতে পারেননি। এমনকি তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার বিয়ের সময়েও তিনি কারাগারে ছিলেন। সারাজীবনই বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। তিনি বাঙালীকে নিজের আত্মপরিচয় জানার পথে নিয়ে গেছেন। তিনি বাঙালীকে নিজস্ব স্বকীয় জাতীয়তার পথে নিয়ে তার ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে বাঙালী জাতিসত্তার বীজ রোপণ করেছেন। বাঙালী তাই জাতি হিসেবে স্বাধীন বাঙালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। বাঙালীর আত্মচেতনার পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীরও অসামান্য অবদান আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরই উত্তরাধিকার বহন করে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সঙ্গে তুলনা হতে পারে দৰিণ আফ্রিকার নেলশন ম্যান্ডেলোর সঙ্গে, নেতাজী সুভাষ বসুর সঙ্গে। সুভাষ বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই করেছেন ব্রিটিশের বিরম্নদ্ধে। কিন্তু বাঙালীর জাতীয়তার বিকাশে তার অবদান নেই। তিনি ভারতীয় বলে গৌরববোধ করতেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, আলাদাভাবে স্বতন্ত্র বাঙালী জাতীয়তার চিনত্মা করেননি। সে ৰেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনন্য। তিনি ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি বাঙালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই তো তাঁকে বলা হয়েছে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। যারা তাঁর ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপনক রতে চায়, তারা আবর্জনা হিসেবে অাঁসত্মাকুড়ে নিৰিপ্ত হবে।
বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ভারত ত্যাগ করে। ব্রিটিশের বিরম্নদ্ধে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দীর্ঘ সংগ্রাম করে। মহাত্মা গান্ধী এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। কংগ্রেস কর্মী ও নেতৃবৃন্দ কারাগারে নির্যাতিত হয়। ৰুদিরাম ও আরও অনেকের ফাঁসি হয়। অনেককে আন্দামানে দ্বীপানত্মর করা হয়। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মকর্তাদের অপরিসীম ত্যাগে ভারত স্বাধীন হয়। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় বাঙালী নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার প্রসত্মাব করেন। লাহোর প্রসত্মাব নামেখ্যাত হয় এই প্রসত্মাব। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক আইন সভার সাংসদদের কনভেনশনে আর একজন বাঙালী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই প্রসত্মাবের সংশোধনী আনেন। এই সংশোধিত প্রসত্মাবে একটি মাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। তদনুযায়ী ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারত ভাগ করে দুইটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠা করে। সেই সঙ্গে বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাব প্রদেশও বিভক্ত হয়। অনুন্নত কৃষি প্রধান পূর্ববঙ্গ পাকিসত্মানের অংশ হয়। শিল্পোন্নত পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশই থেকে যায়। সমৃদ্ধ বন্দর নগর কলকাতা ভারতের অঙ্গীভূত হয়। এই বিভাজনে বাঙালী মুসলমান ৰতিগ্রসত্ম হয়। এই সময়ে মুসলিম লীগের বাঙালী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম, কংগ্রেস নেতা কিরণ শংকর সেনগুপ্ত, নেতাজী সুভাষ বসুর ভাই শরৎ বসু বঙ্গদেশকে অখ-িত রেখে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন বাঙালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। প্রধানত কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরোধিতার জন্য এই চেষ্টা সফল হয়নি। উলেস্নখ্য, অখ- বৃটিশ ভারতে ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিসত্মান ইসু্যর ভিত্তিতে নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে একমাত্র অবিভক্ত বঙ্গদেশে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মন্ত্রিসভা গঠন করে। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পর্যায়ক্রমে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হন। ভারত বর্ষের অন্য কোন প্রদেশে মুসলিম লীগ জিততে পারেনি। পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার সময় পশ্চিম পাকিসত্মানের অনত্মভর্ুক্ত পাঞ্জাবে পাকিসত্মানবিরোধী ইউনিয়নিস্ট পার্টির মন্ত্রিসভা ছিল, উত্তর-পশ্চিম সীমানত্ম প্রদেশে সীমানত্মগান্ধী নামে খ্যাত খান আব্দুল গফফার খানে খুদাই খিৎমতগার দলের মন্ত্রিসভা ছিল। এই দলটি পাকিসত্মানবিরোধীও অখ- ভারতের পৰে ছিল। সিন্ধু প্রদেশেও পাকিসত্মানবিরোধী মন্ত্রিসভা ছিল। মোটকথা, পশ্চিম পাকিসত্মানের কোন প্রদেশেই পাকিসত্মান সমর্থক মন্ত্রিসভা ছিল না। অথচ পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার পরে পশ্চিম পাকিসত্মানী নেতৃবৃন্দ হয়ে গেলেন দ-মু-ের কর্তা শাসক আর যে বাঙালীরা পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠা করল তারা হয়ে গেলে তাদের প্রজা। পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই বাঙালী ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। অবশ্য প্রধানত দায়ী বাঙালীদের কীব নেতৃত্ব। তারা মেরম্নদ-হীন পশ্চিম পাকিসত্মানী নেতাদের তাঁবেদার ছিলেন। পাকিসত্মানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালী হওয়া সত্যেও বাঙালীরা সর্বরকম রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলো। এমনকি বাংলা ভাষাকে তারা স্বীকৃতি দিল না।
পাকিসত্মানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকার জনসভায় ঘোষণা করলেন, উদর্ু এবং একমাত্র উদর্ুই হবে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা। বাঙালী মর্মাহত ও বিৰুব্ধ হলো। সভাস্থলেই মৃদু প্রতিবাদ হলো। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় তাদের ৰুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। তাই ছাত্রদের মৃদু আপত্তি ছাড়া তেমন সরব প্রতিবাদ হলো না। তবে দেশবাসী আশাহত ও ৰুব্ধ হলো। তরম্নণ ছাত্ররা চুপ থাকল না। তারা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরম্ন করল। ইতোমধ্যে কংগ্রেস দলীয় পাকিসত্মান গণপরিষদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা গ্রহণ করার প্রসত্মাব করেন। পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান অশালীন ভাষায় শ্রী দত্তকে আক্রমণ করেন। তমুদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে অভিনন্দন জানানো হয়। পরে শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের এগারোই মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। সেদিন সচিবালয়ের গেটে পিকেটিং করার সময় ছাত্রলীগের শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, আব্দুল ওয়াদুদ, আজিজ আহমদসহ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশনের বাহাউদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খানসহ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। বাহাউদ্দীন চৌধুরী জাঁদরেল পাঞ্জাবী চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে তাকে পদব্রজে অফিসে যেতে বাধ্য করেন। এতে পুলিশ ৰিপ্ত হয় তাকে প্রচ- মারপিট করে। বন্দুকের কুদার আঘাতে তার বাম হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলতে থাকে। সেই অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশি প্রহরায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়। মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতে তার পরিবারের তদবিরে তিনমাস পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালে শুরম্ন হয়ে ১৯৫২ সাল পর্যনত্ম বিভিন্ন সময়ে ভাষার দাবিতে ছাত্ররা সভা, সমাবেশ ও মিছিল করেছে। সব সময়ই পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতার করা হয়েছে। অবশেষে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে যেতে চায়। পুলিশ বিনা হুঁশিয়ারিতে গুলিবর্ষণ করে। কয়েকজন তরম্নণ নিহত হয়। এই তরম্নণদের আত্মহুতিতে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রম্নয়ারিতে রক্তবীজে যে চারাগাছটির জন্ম হয়েছিল একাত্তরে বিশাল মহীরূহ হয়ে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াইয়ে পরিণতি লাভ করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্রের স্থপতি নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী জাতির দীর্ঘ সংগ্রামে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীর অবদান আছে। একদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতীয়তার বিকাশ, অন্যদিকে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে বামপন্থীগণ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তুলে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। এৰেত্রে অবশ্যই শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে স্মরণ করতে হবে।
অগি্নঝরা মার্চ। সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মা এই ঘোষণার তাৎপর্য ঠিকই বুঝেছিল। তাই তারা পঁচিশে মার্চ রাতে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে তার বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। আমার বাড়ি ছিল ধানমন্ডির একত্রিশ নম্বর সড়কে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পরের গলিতে। আমার বাড়ি থেকে আমি হ্যান্ড মাইকে পাকিসত্মানী সেনাদের উদ্দেশে বলা বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ শুনেছি। তিনি বলেছেন, আমাকে নিয়ে যাও, আমার নিরীহ দেশবাসীকে হত্যা করো না। যারা বলে বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তারা মিথ্যা কথা বলে। তিনি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। পঁচিশে মার্চের দিনের বেলা যারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেছেন, তারা অনেকেই বলেছেন, তিনি পালাবেন না। নিজের জীবন বিসর্জন করে দেশকে স্বাধীন করবেন। পাকিসত্মানী সৈন্যদের তাঁকে হত্যা করার সম্ভাবনাই ছিল সর্বাধিক। তিনি অসম সাইসে পাকিসত্মানী সৈন্যদের মোকাবেলা করার সিদ্ধানত্ম নেন। ছাবি্বশে মার্চের ঘোষণার ধারাবাহিকতায় তাঁর সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নামে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর আপ্রাণ চেষ্টায় তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তা লাভে সমর্থ হন। তাজউদ্দীন আহমদকে তাই আমি বাংলাদেশের দ্য গল বলে অভিহিত করেছি। বরং দ্য গলের চাইতেও তার কৃতিত্ব বেশি। বঙ্গবন্ধু যদি হয়ে থাকেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এই রাষ্ট্র নির্মাণের প্রকৌশলী। তাই এই রচনায় আমি তাজউদ্দীন আহমদকেও শ্রদ্ধা জানাই।
স্বাধীনতার ঊনচলিস্নশ বছর অতিক্রানত্ম হয়েছে। কিন্তু যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে তার প্রতিফলন আমাদের জাতীয় জীবনে নাই, একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। অথচ দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীরা সমাজে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাই আজকে আবার আর একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃত আদর্শ পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য এই লড়াই অত্যাবশ্যক।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.