মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার মোশতাকের রহস্যময় ভূমিকা প্রফেসর by মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে 'উদর্ুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' ঘোষণা করার পরই সচেতন বাঙালী জনগোষ্ঠী অনুধাবন করতে পারে যে, পাকিস্তানের সাথে বাঙালীদের একত্রে থাকা সম্ভব হবে না।
বাংলাভাষার দাবিতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের উত্থান ও বিকাশের সাথে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন ঢাকায় রোজগার্ডেনে যখন আওয়ামী লীগের জন্ম হয়, তখন যে অর্গানাইজিং কমিটি গঠিত হয়, সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্মসম্পাদক ও খন্দকার মোশতাক সহসম্পাদক মনোনীত হয়। খন্দকার মোশতাক শেখ মুজিবের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়। কিন্তু প্রথমেই তিনি তার কাছে (মুজিবের) হেরে যান। পরবতর্ীতে ১৯৫৩, ১৯৫৫, ১৯৬৪ ও ১৯৬৬তে আওয়ামী লীগের যে কাউন্সিলগুলো সম্পন্ন হয়, তাতে মোশতাককে কোন গুরম্নত্বপূর্ণ পদে দেখা যায় না। তবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর মোশতাক ৬ দফার প েবিভিন্ন সভা-সমাবেশে যোগদান করেন।
১৯৫৮ থেকে '৬৬ পূর্ব পর্যনত্ম খন্দকার মোশতাককে রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু ৬ দফা যে রাজনৈতিক অঙ্গনকে নাড়া দিয়েছিল তা মোশতাক অনুধাবন করেন। তিনি রাজনীতির দুর্যোগময় সময় নীরবে কাটিয়ে দেন। ৬ দফার প্রচারকালে বঙ্গবন্ধু বারংবার গ্রেফতার হতে থাকেন। মোশতাকও এ সময়ে গ্রেফতার হন এবং পরে তিনি মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালে মার্চ মাসে আয়ুব খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনিও যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে খন্দকার মোশতাক ৩নং সহ-সভাপতির পদ পান। এ সময় থেকে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী জায়গায় চলে আসেন খন্দকার মোশতাক। ১৯৭১ সালের ১৬-২৪ মার্চ ইয়াহিয়া মুজিব আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধু যে হাইকমান্ড গঠন করেন তার মধ্যেও মোশতাক এর সদস্য ছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৩২নং সড়কের বাসভবনে মোশতাককে দেখা যায়নি। তিনি মাঝেমধ্যে এ ধরনের রহস্যময় আচরণ করেন। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী আক্রমণের পূর্বেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আত্মগোপন করেন এবং ৩০ মার্চের মধ্যে অনেকে ভারতে পৌঁছান। মোশতাক এ সময় আগরতলা পৌঁছান। ইতোমধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাাৎ করে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেন। খন্দকার মোশতাক এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেননি। তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছাও সরাসরি ব্যক্ত করেননি তিনি। মন্ত্রিসভা গঠনকালে তিনি প্রথমে নির্লিপ্ত থাকেন পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ দাবি করেন। সে মোতাবেক সিদ্ধানত্ম গৃহীত হয়। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করার পরও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফলে তিনি সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধে মোশতাক নেতিবাচক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে পারেন এই বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে মন্ত্রিসভায় অনত্মভর্ুক্ত করার প্রয়াস চালান এবং তিনি সফল হন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের বা মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সর্বাত্মকভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি। এমনকি তার অনেক কর্মকা- মুক্তিযুদ্ধের বিরম্নদ্ধে যায়।
বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্র দফতর স্থাপিত ছিল কলকাতায় ৯, সার্কাস এ্যাভিনিউতে। এটি পাকিসত্মানের ডেপুটি হাইকমিশন অফিস ছিল। ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী বাংলাদেশের প েআনুগত্য প্রকাশ করায় এ বাড়িটি বাংলাদেশ সরকারের আওতায় চলে আসে। এই ভবনে খন্দকার মোশতাক ছাড়াও তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও মাহবুবুল আলম চাষীর বসার জায়গা ছিল। ব্যারিস্টার মওদুদও বসতেন এ বাড়িতে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- এবং এর পরবতর্ী রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এসব ব্যক্তিবর্গের অনেক নেতিবাচক দিক উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তাদের মধ্যে এ ধরনের কর্মকা- বিদ্যমান ছিল। পার্ক সার্কাসের বাড়িতে বসেই পাকিসত্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ রা করা হতো।
১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল অফিসের রাজনৈতিক সচিবের সাথে এক সাাৎকালে মোশতাক বলেন, ঐব ংধরফ (গড়ংঃধয়ঁব) ইউএ (ইধহমষধফবংয এড়াবৎহসবহঃ) ধিহঃবফ টঝএ (টহরঃবফ ংঃধঃবং এড়াবৎহসবহঃ) ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ ভৎড়স চধশরংঃধহরবং ধহফ ড়ঃযবৎং, ধং বিষষ ধং যবষঢ় রহ ধংংঁৎরহম ঃযধঃ হড় ড়হব রহঃবৎভবৎবৎং রহ ড়ঁৎ ধভভধরৎং. ও ঙঃযবৎং হড় ড়হব বলতে মোশতাক ভারতকেই বুঝিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশ-পাকিসত্মান যুদ্ধের প্রোপটেই এ চুক্তি। কিন্তু পররাষ্ট্র বিভাগের কর্মকর্তা হোসেন আলী (ইতোপূর্বে যার গ্রন্থ আলোচিত হয়েছে) স্টেটসম্যান পত্রিকায় এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন যে, এই চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক কোন প্রভাব ফেলবে না। অথচ সময়ের বিচারে তখন রাশিয়ার ভারতকে সহায়তার অর্থই হলো বাংলাদেশকে সহায়তা করা। হোসেন আলীর মতো একজন বিজ্ঞ কূটনীতিক তা অনুধাবন না করেই এ ধরনের মনত্মব্য করেন। ফলে ভারতের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ প্রোপটেই পরে তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রের কাছে চুক্তির ইতিবাচক দিক তুলে ধরে বিবৃতি দেন। হোসেন আলীর এই বক্তব্য হয়তবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই বক্তব্য ছিল। কিন্তু কথাটা বের হয়েছিল হোসেন আলীর মুখ দিয়ে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক যুদ্ধকালীন সময়ে ভারত সরকারের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেননি, বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিসত্মানের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৭১ সালের ১২ মার্চের পূর্বে উলেস্নখিত চড়ষড়ভভ-এর সাথে হোসেন আলীর একটি বৈঠক থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। বৈঠকে চড়ষড়ভভ হোসেন আলীকে জানান যে, মোশতাকের আগ্রহের পরিপ্রেেিত পাকিসত্মানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ঋবৎষধহফ-এর সাথে ইয়াহিয়া খানের সাাৎ হয়েছে এবং এ সাাতে ইয়াহিয়া জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ প্রতিনিধির সাথে তিনি কথা বলতে প্রস্তুত আছেন। মোশতাক এ জন্যই হয়ত রবিবার যুক্তরাষ্ট্র যাবার চেষ্টা করেন। এমনকি ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ইতোপূর্বে তার কর্মকা- প্রকাশ পাওয়ায় সরকার তাকে যুক্তরাষ্ট্র গমন থেকে বিরত রাখে।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে মুজিব নগর সরকার আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে জনমত গড়ে তোলে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে পাকিসত্মানের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ব্যতীত বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীরাও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন। নোবেল বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য আনত্মর্জাতিক আদালতের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেন। এ পরিপ্রেেিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আনত্মর্জাতিক আদালতে যাবার জন্য চিনত্মা-ভাবনা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প েব্যারিস্টার আমিরম্নল ইসলাম মোশতাকের সাথে সাাৎ করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে মোশতাক আমিরম্নল ইসলামকে বলেন যে, 'তোমাদের ঠিক করতে হবে, তোমরা কি চাও_ বাংলাদেশের স্বাধীনতা না শেখ মুজিবের মুক্তি। আমরা দুটি এক সাথে পাব না।' আমিরম্নল ইসলাম মোশতাকের জবাবে বলেন, 'আমরা উভয়টিই চাই।' শেখ মুজিবিহীন স্বাধীনতা বা স্বাধীনতাবিহীন শেখ মুজিব দুটিই অসম্পূর্ণ। মোশতাকের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়ে যে, তিনি আসলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনটির বিষয়েই আনত্মরিক ছিলেন না। কারণ তখন আপামর জনসাধারণ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন তখন মোশতাকের এ ধরনের মনত্মব্য মুক্তিযুদ্ধে তার অবস্থান নির্ণয়ে সহায়ক।
তবে কোন কোন েেত্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে তার কর্মকা- আবার অতিমাত্রায় সন্দেহজনক। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে ছাড় দিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগ নেতা জহিরম্নল কাইয়ুমকে ভারতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকের কাছে দেন-দরবারের কাজে লাগান। কাইয়ুম মোশতাকের দূত হিসেবে নিয়মিত মার্কিন কূটনীতিকের সাথে যোগাযোগ করেন। এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষ্যে, তিনি ছধরঁস ধঢ়ঢ়বধৎবফ ড়হ ংপযবফঁষব ড়হ অঁমঁংঃ ১৪. ঐব ধভভরৎসবফ ঃযধঃ রভ গঁলরন বিৎব ধষষড়বিফ ঃড় ঢ়ধৎঃরপরঢ়ধঃব রহ ঃযবংব হবমড়ঃরধঃরড়হং, যরং মৎড়ঁঢ় সরমযঃ ংবঃঃষব ভড়ৎ ষবংং ঃযধহ ঃড়ঃধষ রহফবঢ়বহফবহপব ংড় ষড়হম ধং ওংষধসধনধফ ধপপবঢ়ঃবফ অধিসর খবধমঁবং ংরী ঢ়ড়রহঃং. কাইয়ুমের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ব্যাপারে শেখ মুজিবের অনুসারীরা ছাড় দিতে তৈরি ছিল। কিন্তু প্রকৃতপ েঘটনা ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয় নিয়েই শুধু নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মাঝপথে বাধাগ্রসত্ম করার প্রয়াসও চলেছে মোশতাকের নেতৃত্বে। কিন্তু মোশতাক এ েেত্র নেপথ্যে থেকে সব কিছু পরিচালনা করেন। মার্কিন প্রতিনিধি চড়ষড়ভভকে মোশতাক হয়ে জহিরম্নল কাইয়ুম বলেন যে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিসত্মানের সাথে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আগ্রহী। যুদ্ধ বিদ্যমান সমস্যার কোন সমাধান করবে না। কিন্তু ২৩ মার্চের পরে সরকার কখনোই রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেনি, বরং শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যনত্ম পাকিসত্মানের বিরম্নদ্ধে লড়াই করার জন্য বাঙালীরা শপথ নেয়। সরকারের প েপ্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একাধিকবার বলেন যে, সামরিক বিজয়ই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। এমনকি আওয়ামী লীগের এমপি ও এমএলএ-দের সম্মেলনেও (৫ ও ৬ জুলাই ১৯৭১) সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা রার বিষয়ে গুরম্নত্বারোপ করা হয়। এতদসত্ত্বেও রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টাকে স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা বলে গণ্য করা যায়।
পূর্বেই উলেস্নখিত হয়েছে যে, মোশতাক এবং তার অনুসারীরা ভারতে অবস্থান করেও ভারত বিরোধিতায় মগ্ন ছিল। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতার জন্য ভারতীয় বাহিনী যে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তারও বিরোধিতা করে মোশতাকের প্রতিনিধি জহিরম্নল কাইয়ুম। তিনি মার্কিন কনসাল পালোফকে এ নিয়ে বলেন যে, তিনি (জহিরম্নল কাইয়ুম) এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ভারতের অধীনতা বা ভারতের কাছে বিক্রি হবার চাইতে বরং বাংলাদেশ সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রবেশের পরিবর্তে পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীর অবস্থানের প েযুক্তি দেন। জহিরম্নল কাইয়ুম এ বিষয়ে সরাসরি বলেন, ডব ফড় হড়ঃ ধিহঃ ঃযব ওহফরধহ ধৎসু রহ ড়ঁৎ পড়ঁহঃৎু সধহু সড়ৎব ঃযধহ বি ধিহঃ ঃযব চধশ ধৎসু কাইয়ুমের এ বক্তব্য সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতারই শামিল। কারণ বাংলাদেশের প্রয়োজনেই ভারত সরকারের সহযোগিতা চায় এবং মুক্তিবাহিনীকে যেন ভারতীয় বাহিনী সক্রিয় এবং জোরালো সহায়তা প্রদান করে সে নিয়ে সরকারের নিরনত্মর তাগিদ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু মোশতাকের এই তথাকথিত প্রতিমন্ত্রী সরকারের বিপ েএবং প্রকারানত্মরে মুক্তিযুদ্ধের বিপ েএবং পাকিসত্মানের প েঅবস্থান নেন। এ অবস্থান আওয়ামী লীগের তথা সরকারের অনত্মর্দলীয় কোন্দলকেও উসকে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপ েসরাসরি পাকিসত্মানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। মোশতাক বা তার কোন প্রতিনিধি পাকিসত্মানকে এ ধরনের সহায়তা প্রদান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত থাকার জন্য কোন অনুরোধ করেনি। কূটনৈতিক েেত্র বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অনুরোধ করা হয়ে থাকে। বরং কাইয়ুম যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির কাছে এ ধরনের মনত্মব্য করেন যে, ঠধংঃ সধলড়ৎরঃু নবষরবাব ঃযধঃ টঝ রং ঃযব ড়হষু পড়ঁহঃৎু ঃযধঃ পধহ ংধাব ঃযব ংরঃঁধঃরড়হ রহ ঊধংঃ ইবহমধষ। এখানে একটা বিষয় উলেস্নখ করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিস তাদের বিভিন্ন টেলেক্স-এ বাংলাদেশ সরকারকে ইউএ (ইধহমষধফবংয এড়াবৎহসবহঃ) বলে উলেস্নখ করে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রতিনিধি বাংলাদেশ না বলে ঊধংঃ ইবহমধষ ব্যবহার করেছেন। তাতেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সমর্থনকে পরিমাপ করা যায়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতায় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান সত্ত্বেও মোশতাক পাকিসত্মানের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার আগ্রহী ছিলেন। পূর্বেই উলেস্নখিত হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে মোশতাক স্বাধীনতা নিয়ে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু এ ধরনের কোন চিনত্মা সরকার বা জনগণের মধ্যে ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাইয়ুমের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ধারণা দেয় যে, যদি মুজিব বেঁচে থাকে তাহলে পাকিসত্মানের সাথে সমঝোতা সম্ভব। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজেও কোন সমঝোতায় বিশ্বাস ছিলেন না। তার ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়েছে। তিনি ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণায় রক্তবিন্দু দিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিসত্মানী সৈন্যদের বিতাড়িত করার কথা বলেন। অতএব পাকিসত্মানের তখন সরকারের সমঝোতায় পৌঁছাবার কোন সুযোগই ছিল না। খন্দকার মোশতাকের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয় ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে তার উদার মনত্মব্যে। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পূর্বেলেস্নাখিত চড়ষড়ভভ-এর সাথে মোশতাকের ৯০ মিনিটব্যাপী একানত্ম সাাৎকারে মোশতাক ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে ও শহড় িণধযবধ, ও শহড় িযরস ঃড় নব ধ মড়ড়ফ ধহফ ও ঃযরহশ যব শহড়,ি ঃযধঃ ও ধস ধ মড়ড়ফ সধহ. ১৯৭১ সালে কামরম্নল হাসানের একটি ব্যঙ্গচিত্রে ইয়াহিয়া খানকে জানোয়ার বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং এটি সমগ্র বাঙালীরই অভিধা ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বরে যখন মোশতাক ইয়াহিয়াকে একজন ভাল মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তখন বাংলাদেশের ল ল নারী-পুরম্নষ তার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ইয়াহিয়া খান যখন এক ধিকৃত নাম, তখন মোশতাকের এই মনত্মব্য মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করার শামিল।
শুধু পাকিসত্মানের সাথে যোগাযোগের প্রয়াসই নয়, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার েেত্রও তার অনেক নেতিবাচক কার্যক্রম ছিল। অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক প্রফেসর নূরম্নল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। সেখানে তিনি নবগঠিত সরকার বা বাংলাদেশের প েজনমত গঠনে অংশ নেন। মার্কিন জনগণের অবস্থা ও মুজিব নগর সরকারের করণীয় বিষয়ে তিনি সরকারকে কয়েকটি চিঠি লেখেন। চিঠিগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবার কথা। কিন্তু পরবতর্ীতে তিনি অবহিত হন যে, প্রধানমন্ত্রী এ চিঠির বিষয়ে কিছু জানেন না। এ ঘটনা শুধু পররাষ্ট্র সংক্রানত্ম শিষ্টাচার বহিভর্ূতই ছিল না, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার েেত্র সুনির্দিষ্ট পরামর্শ সংক্রানত্ম এ প্রসত্মাবগুলো সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্থাপন না করা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতারই শামিল বলে গণ্য করা যায়।
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেখাশোনা করতেন আব্দুল মান্নান (এমএলএ)। তাহের উদ্দীন ঠাকুর তাকে সহায়তা করতেন। আব্দুল মান্নান কলকাতার বাইরে অবস্থানকালে একবার (জুন/ ১৯৭১-এর দিকে) তাহের উদ্দীন ঠাকুরকে বাংলাদেশ বেতার দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। এ সময়ে বেতারের এক ধর্মঘট শুরম্ন হয়ে যায়। একটি প্রবাসী সরকারের কর্মচারীবৃন্দ, যারা দেশ মাতৃকার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেন, তারা ধর্মঘটে যেতে পারেন এটা অকল্পনীয়। পরে বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে, এখানেও মোশতাকের হাত ছিল। কারণ তাহের উদ্দীন ঠাকুর মোশতাকের অনুসারী বলে তখনই পরিচিত ছিলেন।
খন্দকার মোশতাকের এসব কর্মকা- সরকারের অজানা ছিল না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মোশতাকের সাথে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এজন্য বিজয় অর্জনের পূর্বে মোশতাকের বিরম্নদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। কিন্তু বিজয় অর্জনের পর ১৯৭৪-এর ১৭ ডিসেম্বর মোশতাককে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। মোশতাক বিষয়টিকে সহজভাবে নেননি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আবার বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি চলে আসেন এবং ১২ জানুয়ারি গঠিত নতুন মন্ত্রিসভারও সদস্য হন। তিনি নিরনত্মর বঙ্গবন্ধুর কাছে তাজউদ্দীনের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি একটা বিষয় নিশ্চিত হন যে, নতুন করে পাকিসত্মানী শাসন আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু পাকিসত্মানী ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রেখে এটা সম্ভব নয়। আবার বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীনকে বাঁচিয়ে রাখলেও এ পরিকল্পনা সফল হবে না। এজন্য তিনি এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- ও ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকা- সংঘটিত হয়।
লেখক : শিৰক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.