রাজধানীতে শিবিরের ৫ শতাধিক মেস ॥ এক শ’ চিহ্নিত- গড়ে উঠছে সরকারী দলের লোকদের বাড়িতেও by গাফফার খান চৌধুরী

রাজধানীতে শিবিরের শ’খানেক আস্তানা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়া আস্তানার মধ্যে ৪৫টি নিজস্ব মেস রয়েছে শিবিরের। দীর্ঘদিন মনিটরিং না থাকায় নিজস্ব আস্তানায় আবার শিবির সদস্যরা বাসা বেঁধেছে।
এর বাইরেও কয়েকশ আস্তানা থাকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসব আস্তানার সঠিক ঠিকানা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বাসা ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এসব আস্তানা। এরমধ্যে সরকার দলীয় একাধিক নেতার বাড়িও রয়েছে। আস্তানাগুলো থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হয়। আস্তানায় থাকা শিবির সদস্যদের দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনা হয়েছে। তাদের ব্যয়ভার বহন করছে জামায়াত।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে জামায়াত-শিবিরের অন্তত ৫ শতাধিক মেস রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র শ’খানেক মেসকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। বাকিগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। মেসগুলোর মধ্যে ৪৫টি জামায়াত-শিবিরের নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলা হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলা মেসগুলো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনামাফিক রাজধানীর প্রায় প্রতিটি থানাভিত্তিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে নতুন নতুন মেস ভাড়া নিয়েছে। ভাড়ার মধ্যে পছন্দের তালিকায় সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কারণ এতে করে গ্রেফতার এড়ানো সম্ভব হবে। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়ি উচ্চমূল্যে ভাড়া নিয়েছে তারা। ইতোমধ্যেই রাজধানীতে যেসব নতুন মেস গড়ে উঠেছে তার মধ্যে একাধিক সরকার দলীয় নেতাকর্মীর বাড়িও রয়েছে। শিবির সদস্যরা এখন আধুনিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে বাড়ি ভাড়া নেয়। তাই ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে সহজেই কারও বোঝার ক্ষমতা নেই। আর কারও বায়োডাটাতে কে শিবির কে জামায়াত কে আওয়ামী বা বিএনপি তা উল্লেখ নেই। বাড়িওয়ালা সব সময়ই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভদ্র ভাড়াটিয়াদের পছন্দ করে থাকেন। শিবির সদস্যদের অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে মানুষের মন জয় করে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। আর এখানেই অনেক বাড়িওয়ালা ভুল করে থাকেন।
বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে সঠিক পরিচয় যাচাই বাছাই করার তেমন কোন সুযোগ নেই। আর এমন সুযোগেই ঢাকায় সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে শিবির। আর এতেই বাজিমাত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহের বাইরে থেকে যাচ্ছে আস্তানাগুলো। অনেক এলাকায় সরকার দলীয় স্থানীয় নেতাদের পকেটে চলে যাচ্ছে জামায়াত-শিবিরের টাকা। ফলে অনেক সময়ই ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা সরকার দলীয় স্থানীয় নেতাদের তদবিরের জোরে অনায়াসে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। আবার কোন কোন সময় আটককৃত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সরকার দলীয় লোক বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে করে আটকের পর অনেক জামায়াত-শিবির কর্মী ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন অনায়াসে। এমন পরিস্থিতিতে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মধ্যে। সম্প্রতি শিবির পল্টন, মতিঝিল, মৌচাক, মালিবাগ, গুলিস্তান, কুড়িল বিশ্বরোড, মগবাজার, নিউমার্কেট, কাঁটাবন, পল্লবী ও মিরপুরে নতুন মেস নিয়েছে। এসব মেসে অবস্থানকারী শিবির নেতাকর্মীরা মাঝে মধ্যেই মাঠে নেমে আচমকা চোরাগোপ্তা হামলা চালায়।
শিবির মেসগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর শাহআলী থানাধীন উত্তর বিশিলের একটি বাড়ি। বাড়িটি থেকে ৪০ কেজি বিস্ফোরক, ১টি এসএমজি (স্মল মেশিনগান), ১টি বিদেশী স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, ১টি তাজা হ্যান্ডগ্রেনেড, বোমার ২৫টি ডেটোনেটর, তিন ব্যাগ বোমার স্পিøন্টার, ১৮ রাউন্ড এসএমজি ও নাইন এমএম পিস্তলের গুলি, গ্রেনেডের ৩৬টি খোলস, শতাধিক ইলেকট্রিক ও কাঁটাযুক্ত ঘড়ি ও বোমা তৈরির ফর্মুলাসহ প্রচুর জিহাদী বই উদ্ধার হয়েছিল। রাজধানীর পান্থপথ স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে রয়েছে ৩টি বাড়ি। এ বাড়িগুলো থেকে ইতোপূর্বে শিবিরের ৪ জন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা গ্রেফতার হয়েছিল। পরবর্তীতে কল্যাণপুরে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ২টি বহুতল ভবনের মেস থেকে বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। বোমা তৈরির জন্য বিস্ফোরকগুলো দেয়া হয়েছিল ছাত্র শিবিরের মতিঝিল থানা শাখার সাবেক সভাপতি আলমগীর হোসেন ওরফে রাজুকে। পল্টন মোড়ের একটি শিবির মেস থেকে রাজু গ্রেফতার হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন আজিজ মহল্লার মাদ্রাসা গলির ৩/১ নম্বরে একটি শিবির মেস থেকে উদ্ধার হয় অস্ত্র গোলাবারুদ। ওই মেস থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের ৩টি রশিদ বই, বিদেশে যোগাযোগ রাখার কলিংকার্ড ও বেনামী সিমকার্ড উদ্ধার হয়। ওই সময় মোহাম্মপুর থানার ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের শিবির সভাপতি ইমরান ওরফে মাসুম গ্রেফতার হয়। আরেকটি মেস রয়েছে রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন কল্যাণপুর নতুন বাজার এলাকার ডি ব্লকের ৬ নম্বর রোড়ের ৪৭৬/ক নম্বর বাড়িতে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রাজধানীর কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, দারুসসালাম, তুরাগ থানা এলাকায় নতুন করে বহু শিবির মেসের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব শিবির মেসে এক সময় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দীর্ঘ সময় ধরে ওইসব মেসের ওপর তেমন কোন গোয়েন্দা নজরদারী নেই। এমন সুযোগে মেসগুলোতে আবার শিবির সদস্যরা আস্তানা গাড়া শুরু করেছে। এসব মেসে অবস্থানকারীরা ঢাকার বাইরের। তাদের থাকা খাওয়াসহ সব ধরণের ব্যয়ভার বহন করছে জামায়াত। এসব মেসের মধ্যে কোন কোনটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবিও রয়েছে। এতে করে সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। আর এমন সুযোগে পার পেয়ে যাচ্ছে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত জামায়াত-শিবির কর্মীরা।

No comments

Powered by Blogger.