ইন্দোনেশিয়া হাইতি চিলি এরপর ... by শামীম আহমেদ

কান পেতে কি শুনতে পাও বোধ হয় পাও না কারণ তোমার গতিবিধিতে তা বোঝা যায় না।
শুনতে কি পাও
তোমার পতনের ধ্বনি অনুরণিত হচ্ছে।
যদি শুনতে পাও তাহলে তো ভাল
তুমি বেঁচে গেলে
রা পেলে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে।
আর যদি শুনতে না পাও
ধরে নেব বধির তুমি
তোমার পতন অনিবার্য।

ভূ-প্রকৃতির রহস্যময় ও জটিল অচরণ ভূমিকম্প সম্পর্কে আগাম কিছু বলা যায় না। যে কোন সময় যে কোন স্থানে ভূমিকম্প হতে পারে। ভূমিকম্প নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণারও অনত্ম নেই। তবু কোন কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। অদ্যাবদি বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প ঘটার নিয়মনীতি, এর অগ্রিম সতর্কীকরণ বার্তা প্রদান ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন। কখন, কোথায় ও কি মাত্রার ভূমিকম্প হবে তা নির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। তবে টেকটোনিক পেস্নটের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা যায় পৃথিবীর কোন অঞ্চল কি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে ভূমিকম্পে য়তির পরিমাণ যাতে কম হয় সে জন্য মানুষ সতর্কতামূলক পদপে গ্রহণ করতে পারে। পূর্বপ্রস্তুতি বা সাবধানতার কারণে একই মাত্রার বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে য়তির পরিমাণ অনেক কম বেশি হয়। যেমনটি ঘটেছিল হাইতি ও চিলির েেত্র। হাইতির তুলনায় চিলির কম্পনের শক্তি ছিল এক হাজার গুণ বেশি। কিন্তু য়তির দিক দিয়ে হাইতির তির পরিমাণ চিলির চেয়ে কয়েক শতগুণ বেশি।
বর্তমান দশকে তিনটি ভয়াবহ ভূমিকম্প ইন্দোনেশিয়া, চিলি ও হাইতিতে আঘাত হানে। কম্পনের ভয়াবহতায় ল-ভ- হয়ে গেছে দেশ তিনটি। ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের ভূমিকম্পে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার লোক প্রাণ হারায়। আহত হয় হাজার হাজার লোক। ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট রিখটার স্কেলে ৯ দশমিক ১ মাত্রার ওই কম্পনে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক কিছু। য়তির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় লাখ লাখ মার্কিন ডলার। গত ১২ জানুয়ারি ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্স ধ্বংসসত্মূপে পরিণত হয়। এতে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার লোক নিহত, তিন লাখের বেশি আহত এবং ১০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়। ভূমিকম্পের তা-বে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদসহ লাখ লাখ বাড়িঘর বিধ্বসত্ম হয়। দাতাসংস্থা ও ত্রাণকর্মীদের মতে ভূমিকম্পে বিধ্বসত্ম হাইতি পুনর্গঠনে প্রায় এক দশক সময় লাগবে। ক্যারিবীয় এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির ২০০ বছরের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অন্যদিকে, গত ২৭ ফেব্রম্নয়ারির চিলিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় এক হাজার লোক নিহত হয় এবং প্রায় ২০ লাখ লোক গৃহহীন হয়। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৩টি সাত বা ততধিক মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে চিলিতে। অবকাঠামোগত ভিত মজবুত হওয়ার কারণে এত ঘন ঘন ও শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়া সত্ত্বেও চিলিতে য়তির পরিমাণ বরাবরই কম হয়। ভবন নির্মাণে কঠোর আইনের কারণে ভূমিকম্পে খুব কম ভবন ধসে পড়ে। এখনকার বিল্ডিংয়ের নকশা করা হয় ভূমিকম্পবান্ধব হিসেবে। বিদু্যত লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়া বা শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগা, গ্যাস পাইপ ফেটে আগুন লাগা, পানির লাইন ফেটে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো ভূমিকম্পে য়তির পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে। তাই এসব বিষয়গুলো ভূমিকম্পবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। এবার চিলির এত শক্তিশালী কম্পনের পরও চিলির টেলিভিশন ও টেলিফোন সংযোগ অব্যাহত ছিল। ইন্দেনেশিয়া, হাইতি ও চিলিতে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। গত ৪ মার্চ রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প তাইওয়ানে আঘাত হানে। এতে তেমন য়তি হয়নি। যে কোন সময় পৃথিবীর যে কোন স্থানে আঘাত হানতে পারে ভূমিকম্প। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত ভূমিকম্পের ভয়াবহতা দেখেও যারা সতর্ক হচ্ছে না তার বধির। তাদের য়তির পরিমাণও হবে কল্পনাতীত। তাই সবাইকে যার যার শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা জরম্নরী।
কেন বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান পেস্নটের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান। এই দুটি টেকটোনিক পেস্নটের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা একটি আরেকটির ওপর উঠে গেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আর সে েেত্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ অনেক শহর ধ্বংসসত্মূপে পরিণত হবে। সমপ্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতীয় টেকটোনিক পেস্নট বছরে ৬ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বে সরে যাচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের পেস্নট বছরে ২ সেন্টিমিটার করে পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশের শিলাসত্মরের অভ্যনত্মরে বিপুর পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এই সঞ্চিত শক্তি শিলাসত্মরের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলেই ঘটে যাবে মহাধ্বংসযজ্ঞ। ভূমিকম্পের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে উচ্চ, মধ্যম ও কম ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে ফেনী হয়ে ভারতের আসাম পর্যনত্ম বিসত্মীর্ণ এলাকায় গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের ফাটল রেখা থেকে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার পর্যনত্ম ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত ২০০ বছরে ৫০০০টি, ৫ বছরে প্রায় ৬০০টি ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তবে সমপ্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট ছোট মাত্রায় অনুভূত হওয়া এসব ভূমিকম্পগুলো বড় ধরনের কম্পনের জন্য শক্তি সঞ্চার করছে। ফলে যে কোন সময় বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে প্রকৃতিক দানব ভূমিকম্প। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিষয়ে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কমপ্রেহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি), এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারের (এডিপিসি) সহযোগিতায় একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৭৮ হাজার ৩২৩টি ভবন সম্পূর্ণ ধসে পড়বে। আর সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ৩১৬টি ভবন সম্পূর্ণ এবং ৫৩ হাজার ১৬৬টি ভবন আংশিকভাবে বিধ্বসত্ম হবে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে সঙ্গে সঙ্গে ১ লাখ ৩১ হাজার লোক মারা যাবে, আহত হবেন ৩২ হাজার। অবকাঠামে ধ্বংস হবে ৭ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার। সৃষ্টি হবে ১ লাখ ১৫ হাজার ২ শ' টন ধ্বংসসত্মূপ। আবার কোন কোন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলার প্রায় আড়াই লাখ ভবন ধসে পড়বে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে সে বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই।
ঢাকা পৃথিবীর অপরিকল্পিত নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম। একে আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। তার ওপর দালানকোঠা নির্মাণে কোন নিয়মনীতির তোয়ক্কা করা হয়নি। ডোবা-নালা, খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে আকাশচুম্বি দালানকোঠা। প্রতিটি দালান একটি আরেকটির গায়ের সঙ্গে লাগানো। ঢাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ ঘরবাড়ি বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়নি। একটা আদর্শ শহরের নূ্যনতম ২৫ ভাগ রাসত্মা থাকা জরম্নরী। অথচ ঢাকা শহরে রাসত্মার পরিমাণ মাত্র ৭ ভাগ। ঢাকার আবাসিক এলাকার রাসত্মাগুলো খুবই অপ্রশসত্ম। বেশিরভাগ রাসত্মার প্রশসত্মতা ৫ থেকে ১২ ফুট। ছোটখাট দুর্ঘটনা যেমন কোথাও আগুন লাগলে দমকল বাহিনীর কর্মীরা ঘটনাস্থলে পেঁৗছাতে পেঁৗছাতে তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সেেেত্র ভূমিকম্প হলে কি অবস্থা হবে তা সহজে বোঝা যাচ্ছে। সাভারে গার্মেন্টস ধস, র্যাংকস ভবন ভাঙ্গার সময় ছাদ ধসের কথা সবার মনে থাকার কথা। গার্মেন্টস বিল্ডিংটির ধ্বংসসত্মূপ থেকে উদ্ধার কাজ শেষ করতে সাত দিন সময় লাগে। উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আবার র্যাংকস ভবনের ঘটনায় দেখা যায় ছাদ ধসে পড়ে বেশ কয়েক জন কর্মী নিহত হন। ছাদ ধসে পড়ার দশদিন পরও এর নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। আবার রাজধানীর বেশ কয়টি অগি্নকা-ের ঘটনায় দেখা গেছে অগি্ননির্বাপণে আমদের শক্তি, সামর্থ্য কতটুকু। সরকার যদি ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে চান তবে সরকারকে কিছু কঠোর পদপে নিতে হবে।
এক. ভূমিকম্প হলে কিভাবে আত্মরা করতে হবে সে বিষয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অফিস-আদালতে প্রশিণমূলক কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
দুই. ঝুঁকিপ্রবণ তিনটি জেলায়ই ওয়ার্ড বা মহলস্নাভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিটি এলাকার প্রতিটি বাড়িতে যেন ফায়ার সার্ভিস, বুলড্রোজার, এ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় যান বা সরঞ্চাম যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। মোদ্দাকথা রাসত্মাগুলোর প্রশসত্মতা বাড়াতে হবে। এেেত্র ওয়ার্ড কমিশনারদের নেতৃত্বে অনুমোদিত নকশা অমান্য বা বিল্ডিং কোড অমান্য করে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব দিতে হবে।
তিন. উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনার জন্য যে ধরনের সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা এখন থেকে সংগ্রহ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর ব্যবহারে দ করে তুলতে হবে।
চার. সম্ভব হলে প্রতিটি ওয়ার্ডে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলা করা সহজ হবে।
পাঁচ. সরকার যে ৬৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিণ দিচ্ছে উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস, বিদু্যত ও পানির ব্যস্থাপনা বিষয়েও প্রশিণ দিতে হবে। কারণ ভূমিকম্প হলে গ্যাসের চুলা বা বিদু্যতের লাইন থেকে আগুন লেগে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
ছয়. বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা কি হবে তাও পরিকল্পনা করে রাখতে হবে।
পোর্ট অ প্রিন্সে সর্বহারা মানুষের শোকের মাতম শেষ হতে না হতে চিলির মানুষের গগণবিদারী আর্তনাদ আকাশে বাতাসে অনুরণিত হচ্ছে। চিলির আর্তনাদের ফাঁকে কেঁপে উঠেছে তাইওয়ান। আমাদের যেন সেই কাতারে নাম লিখতে না হয়।
ংযধসববসধযসবফ৭৯@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.