ট্রান্সফর্মার চোরদের ধাওয়া ॥ প্রাণ দিল সাহসী পুলিশ

বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চোরদের ধরতে গিয়ে প্রাণ দিতে হলো সাহসী ডিবি পুলিশ এসআই শরিফুলইসলাম খানকে। রবিবার একটি ট্রান্সফরমার চোরেরদল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকা থেকে একটি ট্রান্সফরমার চুরি করে।
ট্রান্সফরমারটি নিয়ে তারা ঢাকার দিকে রওনা দেয়। গোপন সূত্রে পুলিশ আগেই খবর পায়। এ খবর পাবার পরে রাতেই একটি দল পুলিশের পিকআপ ভ্যান মেঘনা-গোমতি সেতুতে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে মাইক্রোবাসে করে ডিবি পুলিশের একটি দল চোরদলের ট্রাকের পিছু নেয়।
চোরদের ট্রাকটি মেঘনা-গোমতি সেতুতে উঠলে পুলিশ ট্রাকটি আটকে ফেলে। সে সময় সাহসী এসআই শরিফুল ইসলাম খান লাফ দিয়ে ট্রাকে উঠে যান। শরীফ যে মুহূর্তে ট্রাকে উঠতে গেছে ওই মুহূর্তেই এক চোর লোহার রড দিয়ে শরিফুলইসলামের মাতায় আঘাত করে। লোহার রডের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে শরিফুলইসলাম ট্রাক থেকে পড়ে যান। শরিফুলপড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চোররা তাদের ট্রাক দিয়ে মাইক্রোবাসটিকে জোরে আঘাত করে ফলে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। আর কি ফাঁকে চোরেরা ট্রান্সফরমারসহ ট্রাক নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। তবে ওই সময়ে পুলিশ পিক আপ ভ্যানটি তাদের ধাওয়া করে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে এক পর্যায়ে চোররা ট্রাকটি জামালদি বাসস্ট্যান্ডে ফেলে দৌঁড়ে পালাতে শুরু করে। পুলিশও তাদের পিছু ধাওয়া করে। এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে চোর ও পুলিশের ভিতর গুলিবিনিময়। গুলিতে শিপননামে এক চোর আহত হয়।
এদিকে আহত শরিফুল ইসলামকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মেডিক্যাল কলেজে আনার পরে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডাক্তাররা যখন জরুরী বিভাগে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছে ওই সময়ে তার সন্তান আট বছরের সাফিন ইসলাম নোভা ও ছয় বছরের হুমাইরা ইসলাম সাজিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনের চত্বরে আপন মনে খেলা করছে। কিন্তু দু’বোন জানে না কিছুক্ষণ আগে কি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তাদের জীবনে। নোভা গোড়ান ‘সাউথ পয়েন্ট’ স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। আর সাজিন নার্সারিতে। রবিবার দুপুরে তখন অদূরেই গোয়েন্দা পুলিশের একটি মাইক্রোবাসে বসে কাঁদছিলেন তাদের মা জেসমিন আক্তার। বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার চোর ধরতে গিয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ট্রান্সফরমার চোরদের হামলায় নিহত হয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের এস আই (উপ-পরিদর্শক) শরিফুলইসলাম। দুই মেয়ে জানে তাদের বাবা ডিউটিতে আছেন। সময় হলেই ফিরবেন বাসায়। স্বামী হারানোর কষ্ট আর দু’সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন তিনি। কী উত্তর দেবেন তিনি দু’সন্তানকে?
ঘটনা রবিবার খুব ভোরের। ঢাকার ডিবি পুলিশের কাছে তথ্য ছিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বা ক্যান্টনম্যান্ট এলাকা থেকে দুর্বৃত্তরা বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি করে ঢাকার দিকে নিয়ে যাবে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আগেই সেখানে ডিএমপি পুলিশের একটি দল ওত পেতে ছিল। গজারিয়ার মেঘনা-গোমতী সেতুর (দাউদকান্দি) উপর একটি পুলিশ ভ্যান আগে থেকেই অবস্থান করছিল। চোরাই বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বহনকারী ট্রাকের পেছনে পুলিশের আরেকটি মাইক্রোবাস ছিল। পরে ট্রাকটি ব্রীজের উপর আসলে। পুলিশ ট্রাকটিকে আটকে ফেলে। সে সময় এস আই শরিফুলইসলাম খান ট্রাকে উঠলে এক চোর লোহার দন্ড দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করলে তিনি পড়ে যান। গুরুতর আহত অবস্থায় শরীফুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, চোররা ট্রকটি দ্রুত পেছনে থাকা মাইক্রোবাসটিতে আঘাত করে পালিয়ে যায়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। পরে পুলিশের পিকাপ ভ্যানটি ট্রাকটিকে ধাওয়া করে। চোররা ট্রাকটি জামালদি বাসস্ট্যান্ডে ফেলে রেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। সেখান থেকে ১ কিলোমিটার দুরে বাসেত সরকারের বাড়িতে পুলিশের সাথে চোরদের গুলিবিনিময় হয়। এ সময় ৬ রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। এতে শিপন নামের এক চোর গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শিপনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। শিপন বর্তমানে ডিবি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। বাকী চোররা পালিয়ে যায়। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন খান জানান, চোরের ব্যবহৃত ট্রাক এবং চোরাই একটি ট্রান্সফরমার ও কিছু কাঠের গুড়ির বস্তা এবং চুরিতে ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ ট্রাকটিকে জব্দ করেছে পুলিশ।
ঘটনাস্থলের বাড়ির মালিক বাসেত সরকার (৫৫) জানান, রবিবার খুব ভোরে গোলাগুলির শব্দ শুনে জেগে উঠি। দরজা খুলে দেখতে পাই পুলিশের গুলি খেয়ে এক চোর আমার বাড়ির উঠানে এসে পড়ে যায়। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে যায়। এ সময় বেশ কয়েকটি পিস্তলের গুলির খোসা পড়ে ছিল বাড়ির উঠোনের পাশে। তাছাড়া আহত চোরের শরীর থেকে ঝড়ে পড়া রক্তের দাগও লেগে ছিল উঠানের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শী আমিরুল ইসলাম জানায় ভোরে গোলাগুলির শব্দ শুনি। ভয়ে ঘর থেকে বের হয়নি। পরে বের হয়ে দেখি বাড়ির উঠানে রক্তের দাগ ও গুলির খোসা পড়ে আছে।
গজারিয়ার ভবের চর হাইওয়ে পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ সাজেন্ট জয়নাল আবেদিন জানান, হাইওয়ে পুলিশ ট্রাকটি পরিত্যাক্ত অস্থায় উদ্ধার করেছে। এসময় ট্রাকটিতে বিদ্যুতের একটি ট্রান্সফরমার ১৮টি কাঠের গুড়ি বা কুড়ার বস্তা ও ৩টি কাটার পাওয়া গেছে। গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এ ঘটনায় গজারিয়া থানায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।
গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম ॥ স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ থেকে জানিয়েছেন, এস আই শরিফুলইসলাম খানের (৩৫) গ্রামের বাড়ি বেলকুচির চন্দনগাঁতীতে এখন শোকের মাতম চলছে। সকালে তার পরিবারের লোকজনের কাছে শরীফুলের নিহত হওয়ার সংবাদ পৌছলে শোকের মাতম শুরু হয়। পিতা বাকরুদ্ধ ও মা সন্তানের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরাও তাদেরকে সান্ত¡না দেবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তার লাশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে জানাযা শেষে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হলে রাতেই চন্দনগাঁতি গার্লস হাই স্কুলে দ্বিতীয় দফায় জানাযা শেষে তাকে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ।
এসআই শরিফুল১৯৯৮ সনে পুলিশে যোগ দেন ও ২০১০ সনে এসআই পদে পদোন্নতি পান। পিতা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ খান ও মাতা তহমিনা বেগমের ৩ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। শরীফুলের স্ত্রী জেসমিন খাতুন ও ২ মেয়ে সাফিন (৯) ও সাজিন (৫)। একমাত্র বোন রওশন আরা পারভীন চন্দনগাঁতি গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
শরিফুলইসলাম বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। ২০১০ সালের বই মেলায় তার লেখা সত্য ধ্রুব, প্রতিভা, ফাল্গুনের বিকেল, ২০১১ সনে ছোটদের জন্য লেখা ভুতবন্ধু, ছন্দে ভরা মিষ্টি’ ছড়া বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর বই মেলাতে আবার ফিরে যাবো মুক্তিযুদ্ধে শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হবার কথা। ঢাকার চারুলিপি প্রকাশনী তার সব বই প্রকাশ করেছ্রে। এ ছাড়া তিনি ফোকাস বাংলা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পরিবেশ ও মানবাধিকার
বাস্তবায়ন সোসাইটি, শব্দশীল একাডেমী, বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ সম্মাননা পুরস্কার ছাড়াও ২০১১ সনে স্টারগোল্ড পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.