চারুশিল্প: বীরেন সোমের চিত্রকলা- প্রকৃতির গীতিকাব্য by সামসুল ওয়ারেস

শিল্পী বীরেন সোমের ‘বিমূর্ততার মধ্যে জীবনবাদ’ শীর্ষক একক চিত্রকলা প্রদর্শনী তেল, অ্যাক্রিলিক ও মিশ্রমাধ্যমে মোট ৭০টি চিত্রকলা নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রদর্শনী চলবে ১ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
বীরেন সোমের চিত্রকলা মূলত কম্পোজিশন-আশ্রিত। আকর্ষণীয় রং ও জ্যামিতিক গঠনে নির্মিত কম্পোজিশন। রং জ্যামিতিক গঠনকে আশ্রয় করে ব্যক্ত হয় এবং জ্যামিতি এখানে মুখ্য। আবার কখনো রং স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্যামিতিকে অস্বীকার করে হয়ে ওঠে মুক্ত, স্বাধীন। কখনো রং ক্যানভাসজুড়ে বিস্তৃত থাকে, যেখানে তল-বিভক্তি নেই। আবার কখনো রঙের স্বতঃস্ফূর্ত ফর্ম ক্যানভাসের মধ্য ভাগে ছড়িয়ে থাকে, চারপাশে তল (ব্যাকগ্রাউন্ড) সৃষ্টি করে। বীরেন সোম এক কম্পোজিশন-বিশেষজ্ঞ রঙের জাদুকর।
বীরেনের বলিষ্ঠ কম্পোজিশনে নানা রঙের সমারোহ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চিত্রে গতিময়তা সৃষ্টি করে। ক্যানভাস গাত্রে রঙের প্রলেপ, সঞ্চারিত কম্পন ও উজ্জ্বল রংগুলোর বিন্যাস সৃষ্টি করে এক রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি। ক্যানভাসে ভাসমান আয়তাকার জ্যামিতিক গঠন ও এর বিপরীতে চিত্রে অভিব্যক্তিময় অঞ্চলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট টেনশনের কারণে প্রতিটি চিত্রকর্ম হয়ে ওঠে এক নাটকীয় অভিজ্ঞতা। এই বিপরীতমুখী শক্তির সক্রিয় চাপ ও টানে সৃষ্ট হয় চিত্রে অবস্থিত অন্ত্যমিল।
বীরেন সোমের চিত্রকলায় একধরনের বিমূর্ত অভিব্যক্তি বিধৃত হয়, যা বাস্তবতাকে অনুসরণ করার অঙ্গীকারেই নির্মিত। চিত্রে স্বতঃস্ফূর্ত ও আপাত-অরাজক গঠনগুলো ক্রমেই শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে ভারসাম্য তৈরি করে। এ কারণে চিত্রে আসে গতি। দর্শকের মনে সঞ্চারিত হয় স্বচ্ছ এক প্রশান্তি। তাঁর চিত্রকলা যেন মনোজগতের এক সমৃদ্ধ নিসর্গ।
১৯৮৫ সালে বীরেন সোমের জলরং ও ছাপচিত্রের একক প্রদর্শনীতে আবহমান অন্তর্দৃষ্টি বিধৃত হয়। এটা সম্ভব হয়েছিল প্রকৃতির প্রতি বীরেনের অনুরাগের কারণেই। তাঁর এই অনুরাগের জন্ম হয় চাকরিসূত্রে জাতীয় হারবেরিয়ামে কর্মরত সময়ে। সেখানে তিনি লতাপাতা ও ফুলের বৈশিষ্ট্য এবং খুঁটিনাটি প্রত্যক্ষ করেন এবং চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলেন। মানুষের ভালো-মন্দ বা সুখ-দুঃখে প্রকৃতি সম্পূর্ণ নিস্পৃহ, নিরপেক্ষ ও নীরব। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ঊর্ধ্বে প্রকৃতির অবস্থান। বীরেন তাই রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে একনিষ্ঠভাবে প্রকৃতির উপলব্ধিতে ধ্যানমগ্ন। তাঁর এই ধ্যানলব্ধ অর্জনেরই বিমূর্ত প্রকাশ তাঁর এবারের চিত্রকলা।
বীরেন সোমের জন্ম ১৯৪৮ সালে জামালপুরের আমলাপাড়ায়। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর ড্রয়িং শিক্ষক ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বন্ধু রবি দত্ত। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি পান। ১৯৭৯ সাল থেকে এ যাবৎ মোট আটটি একক চিত্রকলা প্রদর্শনীসহ বহু দলগত চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। বীরেন তেলরং, জলরং, অ্যাচিং, অ্যাকোয়াটিন্ট, কলোগ্রাফ, প্যাস্টেল, রেখাচিত্র ইত্যাদি দ্বিমাত্রিক চিত্রকলার সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির গ্রাফিকস ও বুক কভার ডিজাইনার। ১৯৯৮ সালে ৫০০ বুক কভার ডিজাইনের এক প্রদর্শনী হয়েছিল তাঁর। ইতিপূর্বে তাঁর কাজে নারী ফিগার, ভেষজ ফর্ম, নিসর্গ এবং মূর্ত ও বিমূর্ততার নানা প্রকাশ ঘটেছে। এবারই বীরেনের শুধু বিমূর্ত রীতিতে আঁকা চিত্র নিয়ে প্রদর্শনী হচ্ছে।
বীরেনের এবারের প্রদর্শিত বিমূর্ত চিত্রকলায় জ্যামিতি ভিত্তি, রঙের স্কিম ও বিন্যাস এবং সার্বিকভাবে আঙ্গিক উৎকর্ষ মুগ্ধকর। তাঁর চিত্রকলা বক্তব্যপ্রধান নয়, বিশুদ্ধ নান্দনিক আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে বিমূর্ততাই এর প্রধান লক্ষ্য। রং এই চিত্রকলার ভাষ্য তৈরি করে। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যের অনুভব সৃষ্টি করাই এর ভাষার কাজ, দৃশ্যমান বস্তুগত প্রকৃতি নয়। এই অনুভব মস্তিষ্ক-উৎসারিত বোধগম্যে, আবেগমুখী নয়, আবেগের সৃষ্টি হয়েছে চিত্রস্থিত বিভিন্ন সারফেস ট্রিটমেন্ট থেকে। কারিগরি উৎকর্ষ এখানে লক্ষণীয়। চিত্রগাত্রের বিভিন্ন স্থানে এসব ট্রিটমেন্টের ব্যবহার কম্পোজিশনের ভারসাম্যই শুধু রক্ষা করেনি, বরং চিত্রকে অসাধারণ সংবেদনশীল ও নৈপুণ্যতালব্ধ করেছে। সর্বোপরি চিত্রস্থিত বলিষ্ঠ সাবলীলতা তাঁর চিত্রকর্মকে ভণিতাহীন ও প্রাণবন্ত করেছে। এবারের প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে বীরেন সোমের অবস্থান আরও সুসংহত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

No comments

Powered by Blogger.