মুক্তিযোদ্ধা নয়, ওরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল by মমতাজ লতিফ

কিছুদিন আগে আকস্মিকভাবে প্রয়াত প্রখ্যাত দৈনিক সংবাদের কলামিস্ট জহুর হোসেন চৌধুরীর স্মারক বক্তৃতার আয়োজন এবং সে বক্তৃতা প্রদানের জন্য বিতর্কিত ভারতীয় কলামিস্ট কুলদীপ নায়ারের ঢাকা আগমন এবং সংবাদ নয়,
উদ্যোগটি ভোরের কাগজের দ্বারা গৃহীত হওয়ার খবরটি জেনে যেমন বিস্মিত হলাম, তেমনি শঙ্কিত বোধ করলাম এই ভেবে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এমন ব্যক্তিরা কি এখন একে একে আসবে, থাকবে? ঠিক এমন সময়ে দেখলাম ইউরোপীয় আইনজীবীদের উচ্চ পর্যায়ের একটি ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য '৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক ক্রাইমস্ ট্রাইবু্যনাল এ্যাক্টটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এর 'অপরাধ'-এর সংজ্ঞাসহ দু'একটি সংস্থাকে আপটুডেট নয় বলে মন্তব্য করে এতে সংযোজনের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সম্ভবত এই ব্রিটিশ সংবাদদাতা ডেভিড বার্গম্যানের সঙ্গে তাঁর বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত শর্ট ডকুফিল্ম চ্যানেল ফোর-এর সূচনাকালে আমার আলাপ হয়েছিল। খুনী বদর বাহিনী শিকপাড়ায় আসার আগে ঢাকায় দু'দিনের কার্ফিউ বলবত হবার দিন ১২ ডিসেম্বর খুব ভোরে অলৌকিক এক স্বপ্ন দেখে দ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার প্রিয় বাসাটি ত্যাগ করে আমার স্বামী-শিশুসন্তান এবং ভাই ও দেবর ননদের পরিবারসহ আমরা অজানার উদ্দেশে যাত্রা করে বিক্রমপুর পেঁৗছে যে প্রাণে বেঁচেছিলাম সে কাহিনী তাকে শুনিয়েছিলাম সম্ভবত ৮০'র দশকের কোন একদিন। ঘটনাচক্রে ২০০৯-এ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত দু'দিনের যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও এর বিচার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের শেষ দিনে বিকালে সেই ডেভিড সেখানে উপস্থিত হলে তাঁর সাথে আলাপ হয় এবং তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। সে কনফারেন্সে এবং এর আগেও কয়েকটি যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত সেমিনারে আগত প্রায় সব বিদেশী ও বিদেশ প্রত্যাগত স্বদেশীদের '৭১-এর খুনী, ধর্ষক, লুটেরা এবং হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর ল্য বাস্তবায়নকারী, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বিজয় নস্যাতে রত রাষ্ট্রদ্রোহীদের 'মানবাধিকার' রার জন্য অতি উদ্বিগ্ন হয়ে যে সব মন্তব্য-বক্তব্য প্রদান করতে শুনেছিলাম, সেগুলোর কঠোর প্রতু্যত্তর দিয়েছিলাম আমি ও অন্য কয়েকজন। আমার উত্তরের মূল কথা ছিল_ 'তাহলে নিহত, ধর্ষিত এবং তাদের স্বজনদের মানবাধিকার লাভের জন্য তোমাদের কোন চিন্তা নেই, যারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের কাজ রত থেকে খুন হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, আশ্রয়-সম্পদ হারিয়েছে, তাদের মানবাধিকার উপেতি হবে এবং খুনীদের মানবাধিকার রাই বেশি জরুরী? নাৎসীদের উদাহরণও দেয়া হয়েছে। তখন তারা '৭৩-এর আইনটি 'প্রাচীন, আপটুডেট নয়' ইত্যাদি প্রশ্ন তুলেছে। এর পরেও তুলেছে। '৭১-এর ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি এই আইনটিকে খুঁটিয়ে মূল্যায়ন করার জন্য একটি আইনজীবী প্যানেল তৈরি করে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেেিত এটির একটি চূড়ান্ত রূপদানের পদপে গ্রহণ করে। একই সঙ্গে জনগণের কাছে এই আইনের একটি বাংলা সহজপাঠও বিচারপতি গোলাম রাব্বানী সাহেবের দ্বারা করিয়ে নেয়। সরকারও সংসদীয় কমিটি দ্বারা আইনটি পরীা করেছে এবং এতে সামান্য কিছু সংযোজন করে এ্যাক্টটি সংসদে পাস করে। যাহোক, বর্তমান সরকার মতায় অধিষ্ঠিত হতে না হতে যেসব অপ-ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সবই যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীপরে দ্বারা সাংঘটিত হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই যুদ্ধাপরাধী পই বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর হবার পর পর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে হত্যাকারীদের প েনানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর কাজ শুরু করেছে তাতেও সন্দেহ নেই। সে জন্য জনগণকে কতগুলো তথ্য জানতে হবে_
০ খুনী ফারুক-রশীদ '৭১-এর নবেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসে। এরা এর আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের প েভারতের বিপ েযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, যুদ্ধের ফল উপলব্ধি করে তাদের নির্দেশদাতাদের নির্দেশেই কি তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ঢোকেনি? পড়ে এরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অনুপ্রবেশ করে পরাজিত পাকিস্তানীদের প েমুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে কার্যকলাপ পরিচালনা করতেই বিজয়ের আগ মুহূর্তে ছুটে এসে মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে ঢুকে পড়েনি কি? পাকিস্তানীদের প েযুদ্ধ করেনি, এমন হাজার হাজার বাঙালী সৈনিক পাকিস্তানে বন্দী ছিল না কি? প্রভুভক্তরাই যুদ্ধ করেছিল।
ভ যদি তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও হতো, তাহলেও যে মুহূর্তে তারা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সবুজ সঙ্কেত নিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, ভাগিনা, ভাই, ভগি্নপতিসহ বাংলাদেশের জনক, নারী, শিশুদের হত্যা করল, তখনই তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার শত্রু হিসাবে প্রমাণ করেনি কি? শেখ নাসের, শেখ মনি, শেখ কামাল, শেখ জামাল সবাই তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! তারা যদি শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করত, তাহলেও তাদেরকে 'পাকিস্তানী চর' হিসেবে গণ্য করতে অসুবিধা হতো। তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছে যে তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের রক্ত বহনকারী কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না।! শেখ হাসিনা বারবার এদের হত্যার টার্গেট হন কেন?
ভ তারপরও এই খুনী দলই জেলখানায় গ্রেফতারকৃত জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালক সৈয়দ তাজউদ্দীনসহ চারজনকে প্রবাসে পালিয়ে যাওয়ার আগে খুন করেছিল কেন? তারা শেখ মুজিবের রক্ত বহন করে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বহন করে! মুক্তিযুদ্ধের চার প্রধান নেতাকে হত্যার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে কি যে তারা মুক্তিযুদ্ধের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু-ঘাতক? কোন পেশাজীবী যখন ঘাতক হয়েছে, সে মুক্তিযোদ্ধা না যুদ্ধাপরাধী, সে ডাক্তার নাকি প্রকৌশলী, নাকি শিক তা বিচার্য নয়। তার অপরাধের বিচার হবে এবং সে তার সর্বশেষ পরিচয়ে ঘাতক হিসাবেই পরিচিত হবে। ঘাতকের আবার 'রাষ্ট্রীয় মর্যাদা' হতে পারে কি? যারা রাষ্ট্রের জনক ও অন্য জন্মদাতাদের খুন করে, তাদেরকে 'রাষ্ট্রীয় মর্যাদা' দেবার বা 'মুক্তিযোদ্ধা' বলার প্রশ্ন যারা তোলে তাদেরকে খুনীদের প্রত্য মদদদাতা ছাড়া আর কি নামে অভিহিত করা যাবে?
ভ আরেকটা প্রশ্ন না করলেই নয়। কোন একজন খুনী-কন্যা খুনীদের মতোই সদম্ভে বিটিভিতে দাবি করেছে, 'তার বাবা মা চাইবে না, কেননা তিনি কোন অপরাধ করেননি'! প্রশ্নটি হচ্ছে_ খুনী যদি কারও পিতা-পুত্র-ভাই-স্বজন হয়, তাহলে কি তাদের 'খুন'টা কোন অপরাধ হয় না? ধরা যাক, বঙ্গবন্ধুর পুত্রদের কেউ রশীদ বা ফারুককে এবং এদের স্ত্রী-পুত্র-শিশুদের খুন করল, তাহলে কি ঐ খুনটা অপরাধ বলে বিবেচনা করবে না রশীদ, ফারুকদের কন্যা বা স্বজনরা? আসলে এত বিশাল অপরাধ করে যাদের পিতারা 'ইনডেমনিটি' নামক কালো আইনের আশ্রয় পায়, রাষ্ট্রের অসাংবিধানিক শাসকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, উপঢৌকন, ধন-সম্পদ অর্থ-বিত্ত লাভের সুযোগ পায়, তাদের সন্তানরা খুনীর সন্তান হয়েও বড় গলায় চিৎকার করতে পারে! বিলাসী জীবনযাপন করতে করতে তাদের কাছে ওই অপরাধের মাত্রাটা অনুভব করা সম্ভবই হয়নি। তারা অমন অপরাধকে 'অপরাধ' হিসেবে গণ্য করতে শেখেনি। 'ইনডেমনিটি'কে তারা আইন বলে ভুল করেছে। পিতাদের অন্যায্য ৩৪ বছরের দীর্ঘ জীবন আয়ু লাভকে তারা 'অধিকার' বলে ভুল করেছে! এই অসভ্য কুশিাটি তাদেরকে দিয়েছে রাষ্ট্রের অবৈধ শাসকরা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী শাসকেরা! তাদের দাম্ভিক, স্বঘোষিত, স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পিতারাও এ ভুল শিা তাদের দিয়েছে! আইনে, বিচারে সাব্যস্ত খুনীকে 'অপরাধ করেনি' বলে দম্ভ করাও যে রাষ্ট্রদ্রোহের অঙ্গ, তাও সম্ভবত এরা শেখেনি! এ থেকে সবার এ শিা লাভ হয় যে, গুরুতর অপরাধের বিচার না হলে, সঠিক সময়ে বিচার না হলে অপরাধকে অপরাধ বলে মনে হয় না, অপরাধীকে অপরাধীর স্বজনেরা-বন্ধুরা অপরাধী গণ্য করে না। বলা বাহুল্য এ ভুল ধারণা সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করে। সে জন্য অতি দ্রুত বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার আসামিদের দেশে ফেরত এনে প্রথমটির রায় কার্যকর করা দরকার, অপরটির বিচার শুরু করা জরুরী। এর পাশাপাশি '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারও শুরু করা প্রয়োজন। কেননা এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি '৭১ ও '৭৫-এর খুনীদের প েবিবেক বিক্রি করা দেশী-বিদেশী খুনীদের মানবাধিকার রায় আকুল উদ্বিগ্ন মতাবান উচ্চশিতি মানুষজন নানা প্রচারণার উপাদান ও উপকরণ নিয়ে দেশে আসতে শুরু করেছে! সুতরাং সাবধান! এখন ঐ গ্রামীণ কৃষকটির ছাগলকে শূকর বানিয়ে ছাড়বার জন্য তারা অাঁটঘাট বেঁধে নেমেছে।
কৃষকের ছাগলের স্থানে এখন রয়েছে আমাদের গর্বের ধন_ '৭৩-এর আন্তর্জাতিক ক্রাইমস ট্রাইবু্যনাল এ্যাক্টটি! গৃহপালিত ছাগলকে হাটে বিক্রি করতে যাওয়া কৃষকটি যখন বেশ কিছুদূর পর পর দাঁড়ানো তিন শঠের মুখে তিন বার শুনতে পেল, ওর ঘাড়ের জীবটা ছাগল নয়, সে একটা শূকরকে ঘাড়ে নিয়ে চলেছে, তখন তৃতীয় জনের মুখেও একই কথা শুনে সে নিশ্চিত হয়, তাহলে এটি ছাগল নয়, শূকরই হবে। সে ছাগলটিকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে চলে যায়! আর তিন শঠ সেই ছাগলের মাংস দিয়ে ভোজ খায়। হায়! '৭৩-এর আন্তর্জাতিক ক্রাইমস ট্রাইবু্যনাল এ্যাক্টটি যেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দুই প্রখ্যাত আইনীবীদের সঙ্গে বসে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক ইচ্ছায় '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল, সেটিকে এখন 'প্রাচীন' 'অপর্যাপ্ত' বলে সরকারের 'ঘাড় থেকে নামিয়ে' দিতে দেশে-বিদেশে শত শত ব্যক্তি নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে! এরা '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের প,ে বিশেষত খুনী ও ধর্ষকদের, সম্পদ দখলকারীদের, এমনকি যারা বিচার এড়িয়ে যাবার সুযোগে আবারও জঙ্গী-মৌলবাদীর জন্ম দিয়ে বদর বাহিনীর মতোই কিন্তু শতাধিক খুনী দল তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দল, দলের নেতা-নেত্রী-কমর্ী, সমাজের বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল অংশ_ শিক-কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-নাট্যকমর্ীদের এবং গণতন্ত্রের প্রতীক শেখ হাসিনাকে খুনের জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের 'মানবাধিকার' রার জন্য দেশে-বিদেশে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কি তাহলে লাদেন, আয়মান আল জাওয়াহিরি প্রমুখ আল কায়েদা নেতার 'মানবাধিকার' রার জন্য তাদের স্ব স্ব সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে? হিটলার এবং নাৎসী নেতাদের মানবাধিকার রার জন্য ইউরোপের আইনজীবীরা বা মানবাধিকার কমর্ীরা কোন দাবি কখনও তুলেছেন বলে শোনা যায়নি। অতএব সাধু সাবধান!

No comments

Powered by Blogger.