বিচিত্রিতা- সময়ের আয়নায় নিউজউইক

সাংবাদিকতাকে বলা হয় ইতিহাসের প্রথম খসড়া। সে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী নিউজউইক ইতিহাসের একেকটি পাতা। যে সাময়িকী ইতিহাস ধারণ করেছে ৮০ বছর ধরে; সেই সাময়িকী ২০১২ সালের শেষ দিন বাজারে ছাড়ল তাঁর শেষ মুদ্রিত সংখ্যাটি।
প্রচারসংখ্যা হ্রাস পাওয়া, বিজ্ঞাপন-সংকট ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বাণিজ্যিক কারণে মুদ্রিত ইতিহাসের ময়দান থেকে বিদায় নিল বিশ্বব্যাপী অসম্ভব জনপ্রিয় এই সংবাদ সাময়িকীটি। ২০১২ সালকে বিদায় জানানোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পৃথিবীর পাঠকেরা যেন বিদায় দিয়ে দিল ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য চরিত্রকে।
৮০ বছর ধরে সাময়িকীটি নিজেকে সময়ের সঙ্গে বদলেছে; উত্থান-পতনের সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরেছে, একই সঙ্গে নিজেকে তৈরি করেছে ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। সময়ের বহমানতায় নিউজউইক ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করলেও পেছনে রেখে যাচ্ছে এক সমৃদ্ধ অতীত। যে অতীত নস্টালজিয়ার, আবেগের আর সমৃদ্ধ সাংবাদিকতার।
প্রিয় পাঠক, আসুন, একটা নজর বোলানো যাক নিউজউইক-এর সমৃদ্ধ অতীতের দিকে।
১৯৩৩: টমাস জেসি মার্টিনের মালিকানায় প্রথম বের হয় নিউজউইক। সম্পাদক ছিলেন স্যামুয়েলস টি. উইলিয়ামসন। প্রথম বছরে এর প্রচারসংখ্যা ৫০ হাজার কপি ছুঁয়েছিল।
১৯৩৬: প্রথমবারের মতো নিউজউইক-এর প্রচ্ছদ ছাপা হয় চার রঙে।
১৯৩৭: টুডে সাময়িকী নিজেদের বিলুপ্ত করে দিয়ে নিউজউইক-এর সঙ্গে মিলে যায়। মালিকানায় আসে রদবদল। মাস্টহেডেও আসে পরিবর্তন। এ বছর থেকেই নিউজ-উইক নিউজউইক হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। ‘মন্তব্য প্রতিবেদন’ ছাপা হওয়া শুরু হয় প্রথমবারের মতো, জনপ্রিয়তাও পায় খুব দ্রুত। এ বছর এর প্রচারসংখ্যা দুই লাখ ৫০ হাজার অতিক্রম করে।
১৯৩৯: একাদশ পোপ পাইয়াসের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল কোনো মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে নিউজউইক-এ প্রকাশিত প্রথম প্রচ্ছদ কাহিনি।
১৯৪১: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে যেদিন জাপানিরা আক্রমণ করেছিল, তার এক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত এক সংখ্যায় নিউজউইক জাপানি বাহিনীকে ‘প্রাচ্যের ডিনামাইট’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। এ বছরই এর প্রচারসংখ্যা পাঁচ লাখ স্পর্শ করে।
১৯৪৩: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের সুবিধার্থে নিউজউইক প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্রাকৃতির একটি সংস্করণ প্রকাশ করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘ব্যাটল-বেবি।’
১৯৪৫: বিভিন্ন মহাদেশে আলাদা আলাদা সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়।
১৯৫৪: প্রচারসংখ্যা ‘১০ লাখ’ স্পর্শ করে।
১৯৬৪: বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড ‘বিটলস’কে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি ছাপা হয়। নিউজউইকই প্রথম মার্কিন সাময়িকী, যারা কোনো ব্যান্ড দলকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশ করে।
১৯৬৬: নিউজউইক-এ প্রথমবারের মতো প্রতিবেদকদের নামে (বাইলাইন) প্রতিবেদন ছাপা শুরু হয়।
১৯৬৭: প্রেসিডেন্ট জনসনের সামাজিক অধিকার অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ। ৪০ জন গবেষকের সমন্বয়ে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এক হাজার ২৫০টি কেস স্টাডি ছাপিয়েছিল নিউজউইক।
যে প্রতিবেদন ১৯৬৮ সালে নিউজউইককে সাংবাদিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়।
১৯৭২: নিউজউইক-এ প্রথমবারের মতো কোনো নারী কলামিস্টের কলাম ছাপা হয়। এই নারী কলামিস্টের নাম ছিল বিল মোয়েরস।
১৯৮৩: নিউজউইক-এ প্রকাশিত হয় ‘হিটলারের ডায়েরি’। প্রচ্ছদ কাহিনি হিসেবে প্রকাশিত এই ‘হিটলারের ডায়েরি’ চারদিকে হইচই ফেলে দেয়। প্রচারসংখ্যা এ বছরই ৩০ লাখ অতিক্রম করে।
১৯৯৯: মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘মনিকা কেলেঙ্কারি’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজউইক। প্রতিবেদনটির নাম ছিল ‘ক্লিনটন অ্যান্ড দ্য ইন্টার্ন’। এই প্রতিবেদনটির জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করে নিউজউইক।
২০০০: নিউজউইক-এ প্রথমবারের মতো কোনো সাহিত্যকর্ম ছাপা হয়। এতে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মটি ছিল ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড গোবেল্ট অব ফায়ার’।
২০০১: নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার পর নিউজউইক-এ ‘হোয়াই দ্য হেইট আস’ নামের একটি প্রচ্ছদ কাহিনি বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দেয়। ওই প্রচ্ছদ কাহিনিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মনোভাব তুলে ধরেছিলেন ফরিদ জাকারিয়া।
২০১১: অ্যাপলের আইপ্যাডে নিউজউইক অ্যাপ্লিকেশন চালু হয়। এটি ছিল নিউজউইক-এর ‘ডিজিটাল’ হয়ে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। আইপ্যাডের এই অ্যাপ্লিকেশনটি পুরস্কার লাভ করে।
২০১২: শেষবারের মতো নিউজউইক-এর ছাপা সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
 নাইর ইকবাল

No comments

Powered by Blogger.