হাসপাতালে অবহেলায় চিকিৎসকের মৃত্যু

ঢাকায় অস্ত্রোপচার করাতে এসে মারা গেলেন বিশিষ্ট হূদেরাগ চিকিৎসক ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এম মাজহারুল ইসলাম (৪৪)। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
মাজহারুল ইসলাম পাইলসের (অর্শ) অস্ত্রোপচার করাতে গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার পান্থপথের গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, ওই হাসপাতালের চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুলের কারণেই মাজহারুল মারা গেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও তাদের প্রতিবেদনে একই কথা বলেছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মাজহারুল ইসলামের ছোট ভাই ইউএনডিপির কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ডিসেম্বর গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসক এস কে আবু জাফর ও মাহবুবুল হাসান তাঁর ভাইয়ের অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরপরই তাঁর ভাই হূদেরাগে আক্রান্ত হন। সংকটাপন্ন অবস্থায় ওই দিন রাতেই তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
মাজহারুল ইসলামের বাবা এস এম শওকত আলী, স্ত্রী শামিমা সুলতানা, ছোট বোন শামীমা সুলতানা, ভগ্নিপতি মোহাম্মদ ফারুক প্রত্যেকেই চিকিৎসক। তাঁরা সবাই অভিযোগ করেছেন, হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলায় মাজহারের মৃত্যু হয়েছে।
মাজহারুল ইসলামের ভগ্নিপতি ল্যাবএইড হাসপাতালের আইসিইউ পরামর্শক মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৩ তারিখ দুপুর দুইটায় মাজহারের ক্লোনোস্কোপির একটি অস্ত্রোপচার হয়। সে সময় তাঁকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়েছিল। এরপর ২০ ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর পাইলসের অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে আবারও তাঁকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়। অথচ এ ক্ষেত্রে আংশিক অজ্ঞান করলেই চলত। আসলে ভুল চিকিৎসা আর অবহেলার কারণেই হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মাজহারের মৃত্যু হয়েছে।’
অস্ত্রোপচারের সঙ্গে জড়িত বারডেম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক এস কে আবু জাফর এবং অবেদনবিদ মাহবুবুল হাসান দুজনেরই মুঠোফোন এখন বন্ধ। ফলে তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম খুবই ভালো এবং জনপ্রিয় চিকিৎসক ছিলেন। তিনি আমাদের হাসপাতালেরও হূদেরাগ বিভাগের পরামর্শক ছিলেন। আমরাও তাঁকে স্পাইনাল অ্যানেসথিয়া (শরীরের নিচের অংশের অবশ) করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বলেন, “শরীরের নিচের অংশ অবশ করে জামা-কাপড় খুললে আমার খারাপ লাগবে। পুরোপুরি অজ্ঞান করেন।” তাঁর কথায়ই তাঁকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়।’
মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আধা ঘণ্টা অস্ত্রোপচার হয়। বিকেল চারটা ৪০ মিনিটের দিকে তাঁকে পোস্ট অপারেটিভে নেওয়া হয়। এ সময় তিনি নার্সদের কথায় সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই তাঁর রক্তচাপ (ব্লাড প্রেশার) দ্রুত নামতে থাকে। পাঁচটা-সোয়া পাঁচটার দিকে সব চিকিৎসক এসে অক্সিজেন দেওয়া, ইনজেকশন দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেন। দ্রুত আবার সব স্বাভাবিক হয়। ছয়টার দিকে তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর আবার তাঁর রক্তচাপ কমে যায়। খবর পেয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে আসেন। তাঁরা তাঁকে এখান থেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।’
মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ল্যাবএইডে নেওয়ার পথে তাঁকে কেবল অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিলে। পান্থপথ থেকে ল্যাবএইডে নেওয়ার এই সময়টায় তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের আরও ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে। পরদিন আমরা জানতে পারি, তিনি আসলে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়েছেন। এমন মৃত্যু আসলেই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের।’
তদন্ত কমিটি: ২৪ ডিসেম্বরের ওই ঘটনার পরই জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক শাফি মজুমদারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করেছিল সরকার। কমিটিতে হূদেরাগ বিশেষজ্ঞ, অবদেনবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কমিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, যে ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, সেটি করতে পুরোপুরি অজ্ঞান করার দরকার ছিল না। আংশিক অজ্ঞান করেই ওই অস্ত্রোপচার করা যেত। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ ডিসেম্বর অস্ত্রোপচারের পর মাজহারুলের বিষয়ে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছিল। কমিটি এ ব্যাপারে ওই হাসপাতাল এবং ওই অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। স্বাস্থ্যসচিব হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
মাজহারুল ইসলামের বাড়ি ময়মনসিংহে। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। পরিবার, স্বজন, কর্মক্ষেত্র সবার কাছেই তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ এবং ভালো চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
চিকিৎসক মাজহারুল ইসলামের মৃত্যুতে চিকিৎসকদের দুই সংগঠন ড্যাব ও স্বাচিপ শোক প্রকাশ করেছে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব রাকিবুল ইসলাম তদন্তের ভিত্তিতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.