ভাষা-মানুষের আদি ভাষা ও বাংলা by এমএ হাসান

বাংলা ভাষা অন্যান্য আধুনিক ভাষার মতো একটি মিশ্রভাষা। এ ভাষায় নানা জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষা মিশ্রিত হয়েছে। আরবি, তুর্কি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি রয়েছে বাংলায়। এই মিশ্র জাতিগত, ভাষাগত, সংকর-মিশ্রণ বাঙালি জাতির ঔদার্য এবং সহনশীলতার কথাই ব্যক্ত করে
প্রায় ১ থেকে ২ লাখ বছর আগে আদি মানুষের পরিবর্তিত জিন এমনভাবে কাজ করে যাতে জিভ ও মুখের পেশি অধিকতর সংবেদনশীল এবং গতিময় হয়ে ওঠে। এ কারণেই শব্দ উচ্চারণ সহজ হয়ে ওঠে এবং উৎপত্তি হয় ভাষার। জিনের ক্রমাগত বিবর্তন মানুষের জন্মগত আক্রমণাত্মক মনোভাবকে আপেক্ষিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তি ও সহাবস্থানের প্রবণতাকে জাগিয়ে তোলে। আর এই শান্তিময় সহাবস্থানের পেছনে যা সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হলো ভাষা। এভাবেই আদি মানবের মধ্যে উদয় হয় সৃজনশীলতা ও সহমর্মিতা।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সব ভাষার আদিভাষা এক ও অভিন্ন। আদি মানবের পূর্বপুরুষদের মতো ভাষার জন্মও আফ্রিকায়। তাদের মতে, মানুষ পূর্ণাঙ্গ ভাষা খুঁজে পায় এক লাখ বছর আগে। ব্রিটেনের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ড. কোয়েন্টিন অ্যাটকিনসন্স ৫০৪টি ভাষা নিয়ে গবেষণা করে দেখেন, কিছু ধ্বনি আছে যেগুলো লক্ষ বছর আগে লৌহযুগের মানুষেরা ব্যবহার করত। তাদের মতে, ৭০ হাজার বছর পর আফ্রিকা থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ ছড়িয়ে পড়ার পরই পরিবর্তন হয় ভাষার। আজও আদি ভাষার কিছু কিছু ধ্বনি রয়ে গেছে পৃথিবীর নানা ভাষায়।
এ ক্ষেত্রে লেখক মনে করেন, মানুষের গভীর ব্যথা, বেদনা, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা স্বরতন্ত্রে যে কম্পন সৃষ্টি করে তার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা গঠনতান্ত্রিকভাবে মানুষের াড়পধষ পড়ৎফ-এর মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন ফুসফুসের বায়ু ধারণক্ষমতা এবং কার্যক্রিয়া অনেকটা একই রকম। তারপরও পরিবেশ, বায়ুর চাপ, তাপমাত্রা, জীববৈচিত্র্য এবং তার ধ্বনির একটা প্রভাব রয়েছে ভাষার ওপর।
তুষারাবৃত পার্বত্যাঞ্চলে মানুষ যেভাবে শব্দ উচ্চারণ করে, মরুভূমিতে, পর্বত অঞ্চলে বা গিরিখাদে মানুষ সে রকম ধ্বনি প্রকাশ করে না, নদীর তীরে মানুষ যেমন টেনে টেনে উচ্চস্বরে ধ্বনি প্রকাশ করে, উষ্ণ দিনে গাছের নিচে তা কখনও করে না। উচ্চ মালভূমি অঞ্চলের সঙ্গে সমুদ্রস্তরের একই রকম পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে নদী অববাহিকা অঞ্চলের মানুষের ভাষা ও ধ্বনির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন ভলগা ও গঙ্গাতীরের মানুষ মাতাকে মা অথবা আম্মা বলে, বাবাকে বাবা বা আব্বা বলে। ইরান দেশে বাবাকে পেদার ও ইউরোপে ফাদার বলে। উভয় অঞ্চলে মাকে মাদার বলে। এরা উভয়ই আর্য রক্তধারার ধারক। ধ্বনি উচ্চারণে ফরাসিদের সঙ্গে ফারসিভাষীদের একটা মিল লক্ষণীয়। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়।
বোধগ্রাহ্য অর্থময় ধ্বনিকে ভাষা বলে। বহু বিভক্ত প্রাচীন বঙাল এলাকার ভাষা এই বাংলা। বাঙালির ভাষা আর্য গোষ্ঠীর। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা হলো খাসিয়া, শবর, কোল ইত্যাদি। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা হলো তামিল, তেলেগু মালয়ালাম, কানাড়ি প্রভৃতি। আর্য গোষ্ঠীর আদিভাষা বৈদিক ও প্রকৃত (সংস্কৃত)। পরবর্তীকালে তা বিবর্তিত হয়ে বাংলা, হিন্দুস্থানি, মারাঠি, গুজরাঠি ইত্যাদি ভাষার সৃষ্টি করে। তবে এটা স্মর্তব্য যে, এই ভাষা দ্রাবিড় বা আর্য জাতির পরিচায়ক নয়। ভাষাগোষ্ঠীর পরিচয়মূলক নাম মাত্র। এই দৃষ্টিতেই ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিচার করতে হবে। তিনি বলেছেন, ইবহমধষর রং ধ সবসনবৎ ড়ভ ঃযব ওহফরপ মৎড়ঁঢ় ড়ভ ঃযব ওহফড় ওৎধহরধহ ড়ৎ অৎুধহ ইৎধহপয ড়ভ ঃযব ওহফড়-ঊঁৎড়ঢ়বধহ ভধসরষু ড়ভ খধহমঁধমব. ১৯১১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলা ভারতের সর্ববৃহৎ একক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ছিল। সে সময় ৪,৮৩,৬৭,৯১৫ জন ভারতীয় মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।
বাংলা ভাষা অন্যান্য আধুনিক ভাষার মতো একটি মিশ্রভাষা। এ ভাষায় নানা জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষা মিশ্রিত হয়েছে। শুরুতেই বহু দ্রাবিড় শব্দ তৎসম শব্দরূপে বাংলায় সংযুক্ত হয়। এর মধ্যে বহু তামিল ও কানাড়ি শব্দ রয়েছে। অল্প হলেও সংযুক্ত হয়েছে চীনা ও অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা। প্রচুর ফারসি শব্দ বাংলাকে এমন সমৃদ্ধ করেছে যে তা বাদ দিলে বাংলা ভাষা কিছুটা হলেও জরাজীর্ণ হবে। আরবি, তুর্কি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি রয়েছে বাংলায়। এই মিশ্র জাতিগত, ভাষাগত, সংকর-মিশ্রণ বাঙালি জাতির ঔদার্য এবং সহনশীলতার কথাই ব্যক্ত করে।

ডা. এমএ হাসান : আহ্বায়ক ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস
ফাইন্ডিং কমিটি
aaersci@aitlbd.net

No comments

Powered by Blogger.