শেষ পর্যন্ত সোমেশ্বরীই by শেখ রোকন

 'এর নাম সোমেশ্বরী হলো কেন?'_ প্রশ্নটির মধ্য দিয়ে দলবদ্ধ নীরবতা ভেঙেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জায়েদ ইবনে আবুল ফজল। পহেলা বৈশাখের জ্যোৎস্না রাতে দুর্গাপুরের সঙ্গে বিরিশিরির সংযোগ স্থাপনকারী সেতুর ওপর আমরা দাঁড়িয়ে।
নিচে বালিভরা সোমেশ্বরীতে এক ফালি প্রবাহ চকচক করছে। দূরের পাহাড় ও পল্লীগুলো গায়ে একরাশ আঁধার মেখে দাঁড়িয়ে। নাম না জানা রাতজাগা কয়েকটি পাখি থেমে থেমে ডেকে চলছে। অদূরে কোথাও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের মাইকে হেঁড়ে গলায় গাওয়া 'শিলা কা জওয়ানী' বাদ দিলে বড়ই মায়াময় পরিবেশ। খানিকক্ষণ আগে নিভে যাওয়া বিকেলে আমরা কয়েকজন ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি। দলের কনিষ্ঠতম সদস্য অরিত্র অরিন্দম ছাড়া আর সবাই নদী ও জ্যোৎস্নার মায়ায় খানিকটা চুপচাপ। সেই কেবল শহরের ইট-কাঠ থেকে মুক্তির আনন্দে ছুটোছুটি করছে। নদী নিয়ে হাতুড়ে আগ্রহ থাকলেও সোমেশ্বরী নিয়ে নীরবতা ভাঙা সেই প্রশ্নের উত্তর তখন জানা ছিল না। সোমেশ্বরী আমাদের গন্তব্যও নয়। সুসং দুর্গাপুরের চিনামাটির পাহাড়, নীল পানি, টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ, রানীখং গির্জা ইত্যাদির নামই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। আসার পর থেকে স্থানীয়রাও বারবার বলেছে_ কীভাবে খেয়া নৌকায় সোমেশ্বরী পার হয়ে রিকশায় ঘুরে ঘুরে সেগুলো দেখতে হবে। সে কর্মসূচি পরদিন সকালের। তার আগে সন্ধ্যা কাটানোর জন্য আমরা হাঁটতে হাঁটতে সোমেশ্বরী সেতুতে এসে থেমেছিলাম।
নদীর ওপরে দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে না পারলেও পরে জেনেছি, সোমেশ্বরীর আদি নাম সিমসঙ। যেখান থেকে উৎপত্তি, ভারতের সেই মেঘালয় রাজ্যে এখনও ওই নামেই পরিচিত। গারো পাহাড় অঞ্চলকে দ্বিধাবিভক্তকারী এবং মেঘালয় রাজ্যের দীর্ঘতম এই নদী নকরেক পাহাড়ের চূড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ গারো পাহাড় জেলার মধ্য দিয়ে দুর্গাপুরের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিছুদূর গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একটি ধারা পুরাতন সোমেশ্বরী নামে কলমাকান্দা উপজেলার কাছে বালিয়া নদীতে মিলিত হয়েছে এবং অন্যটি নতুন সোমেশ্বরী বা শিবগঞ্জ ঢালা নামে পূর্বধলা উপজেলার কাছে কংস নদীতে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এসে সিমসঙ কীভাবে সোমেশ্বরীতে পরিণত হলো, তার পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস।
খ্রিস্টাব্দ তেরশ শতকের শেষের দিকে একদল পরিব্রাজক সাধু এসেছিল গারো পাহাড় অঞ্চলে। পাহড়ের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছতোয়া নদীটির পাশে বসে আরাধনার আয়োজন চলছিল। স্থানীয় একদল ধীবর এসে সাধুদের কাছে অভিযোগ করে যে বৈশ্য গারো নামে অত্যাচারী রাজার নির্যাতনে তারা অতিষ্ঠ। পাহাড় থেকে নেমে এসে লুট, অগি্নকাণ্ড, হত্যাকাণ্ড চালায়। তখন সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সাধু ধীবরদের সংগঠিত করে অত্যাচারী রাজাকে হটিয়ে দিয়ে পাহাড় ও সমতলের বিরাট অংশজুড়ে প্রতিষ্ঠা করেন সুসঙ্গ (সৎ সঙ্গ) রাজ্য। আজকের সুসং দুর্গাপুর নাম সেখান থেকেই। আর রাজা সোমেশ্বর পাঠকের নামানুসারে সিমসঙ নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী।অতীতের সুসঙ্গ রাজ্য কিংবা আজকের দুর্গাপুর উপজেলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে সোমেশ্বরী। দুর্গাপুরের যোগাযোগ, কৃষি ও মৎস্যসম্পদে নদীটির অনেক অবদান। টংক আন্দোলনসহ ওই অঞ্চলের অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছে এ স্রোতস্বিনী। লালচে বালি ও স্বচ্ছতোয়া নদীটির পর্যটনমূল্যও কম নয়। শুকনো মৌসুমে এ নদী যেমন মায়া জাগায়, তেমনি বর্ষাকালে হয়ে ওঠে প্রাণ ও শক্তির প্রতীক।
সন্দেহ নেই, সুসং দুর্গাপুরে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। বহুল আলোচিত স্থাপনা ও আহরণ ক্ষেত্রগুলো তো বটেই। খোদ ভূপ্রকৃতিও দর্শনীয়। বাংলাদেশের আর দশটা এলাকা থেকে যে আলাদা, তা প্রথম দর্শনেই বোঝা যায়। না পার্বত্য চট্টগ্রাম, না মধুপুর গড়, না হাওরাঞ্চল, না প্লাবন ভূমি। কিন্তু তাও সোমেশ্বরীর কাছে ম্লান। দিনভর রিকশায় ঘুরে দুর্গাপুরের সব দর্শনীয় ছুঁয়ে এসে সোমেশ্বরী পার হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সোমেশ্বরীই হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। এমন নদীর পাড়ে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় বেশ কয়েকদিন।
ংশৎড়শড়হ@মসধরষ.পড়স
 

No comments

Powered by Blogger.